পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২০

অজানা জ্বর

 অজানা জ্বর

                                                                                              উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী


                                                                অঙ্কন ; তন্দ্রা ব্রহ্মচারী

আজ 'আরএন হাওস'-এ আনান্দের জোয়ার এসেছে , আরএন রায় গ্রুপ অফ কোম্পানিজের চেয়ারম্যান রাথীন্দ্র নাথ রায়ের একমাত্র পুত্র রমেন্দ্র নাথ রায়ের পনেরো তম জন্মদিন। খুব ধুমধাম করে পালন হবে, কয়েকশো অতিথি আমন্ত্রিত, সাদা বাড়িটা আলোয় ঢেকে গেছে। বাড়ির বড় গেটটা ফুল আর বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। গেটের ভিতর ঢুকলেই বিরাট সবুজ ঘাসের মখমলি উঠন আর সেই উঠনে একটা মস্ত বড় ফোয়ারা আছে। ফোয়ারাটাও আজ রংবেরঙের আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। চারিদিকে ব্যস্ততা, শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে যে যুদ্ধকালীন তৎপরতা। কিন্তু এতো আনন্দের মাঝেও একটা বিস্বাদের সুর আছে আর তা হল রথীনবাবুর হটাৎ অসুস্থতা। গত কয়েক দিন ধরেই রথীন জ্বর-সর্দি-কাশিতে ভুগছে, পারিবারিক ডাক্তার ও বাল্যবন্ধু ডাঃ মিহির রঞ্জন চৌধুরী রথীনবাবুকে একদম ঘর বন্দি করে দিয়েছেন, এতে যদিও রথীনের যথেষ্ট আপাত্তি ছিল কিন্তু ওনার উপর বন্ধু মিহিরের প্রভাব এততাই যে তাঁর নির্দেশ আমান্য করতে পানেন নি। একবার শুধু মৃদু আপাত্তির সুরে বলেছিল, “ডাক্তার, হয়েছে তো আমার সামান্য সর্দি-কাশি, তুই এটা নিয়ে কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি করছিস”, জবাবে মুখে মাস্ক লাগাতে লাগাতে মিহির বলেছিলেন, “ডাক্তার আমি না তুই? দেখ এই জ্বর-সর্দি-কাশি মারাত্মক কোন আসুস্থতা নয় ঠিকই কিন্তু আজকালকার এইসব রোগকে অবহেলা কারাও উচিৎ নয়, তোর বাড়িতে একটা বাচ্ছা ছেলে আছে, অন্তত তার সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে আমার কথামত নিয়ম মেনে থাক, কয়েকটা দিনের তো ব্যাপার।” রথীন এর পর আর কোন আপত্তি করে নি।

রথীনের দেখভাল করার দায়িত্ব নিয়েছে ওনার স্ত্রী শর্মিলা, তার ঘরে আপাতত আর কারোর প্রাবেসাধিকার নেই। ডাক্তারের এতো 'বাড়াবাড়ি' রথীনের একমাত্র বোন রজনী হাসি মুখে মেনে নিয়েছে বটে কিন্তু রমেন এতে মোটেই খুশি নয়। এতো ধুমধাম করে তার জন্মদিন পালন করা হচ্ছে আর তাতে কিনা তার বাবাই থাকবে না! এটা যেন সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। এক সময় তো সে জন্মদিনের অনুষ্ঠান বাতিল করবে বলে জেদ ধরে বসেছিল, সবাই মিলে তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার রাজী করিয়েছে।

রথীন আর মিহির ছোট থেকে প্রায় একই সাথে মানুষ হয়েছে, মা মরা মিহিরকে রথীনের মা নিজের ছেলের মতোই দেখতেন এমনকি গরীব ঘরের মেধাবী ছাত্র মিহিরের পড়াশোনার যাবতীয় খরচ রথীনের বাবাই করেছিলেন। এই পরিবারে আরও একজন সদস্য আছে, যার কথা না বললেই নয়, অবনী সরকার। যেমন লক্ষণ ছাড়া রামায়ণ সম্পূর্ণ হয় না তেমন অবনী ছাড়া রথীনের জীবনও অসম্পূর্ণ থেকে যায়। দুজনের সম্পর্ক ঠিক রাম লক্ষণের মতোই। অবনী রথীনের পিসতুতো ভাই, মা-বাবার মৃত্যুর পর রথীনই অবনীকে মানুষ করেছে, লন্ডনের স্কুল অব কমার্স থেকে বিজনেস এডমিনেস্ট্রেশনে স্নাতকোত্তর করে গত কয়েক বছর হলো রথীনের ব্যবসার যাবতীয় দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। তার সুপটু ব্যবসায়ীক কৌশল ও গুনে রথীনের ব্যবসার বেশ উন্নতি হয়েছে। রথীনও অবনীর কর্মদক্ষতায় বেশ খুশি ও নিশ্চিন্ত।

রমেনকে আজ তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় পিসি রজনী খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। খাওয়া দাওয়ার এলাহী আয়োজন আছে। ইতিমধ্যেই অতিথিরা হাজির, কেকও কাটার জন্য তৈরি। বন্ধুরা 'হ্যাপি বার্থডে টু ইউ' গাইতে শুরু করেছে, রমেন ফুঁ দিয়ে পনেরো টা বাতি নিভিয়ে কেক কাটতে যাবে এমন সময় সবার কানে এলো একটা চিৎকার, যা ক্রমশ আর্তনাদের চেহারা নিল। মুহূর্তের আকস্মিকতায় সবাই স্তম্ভিত। সম্বিত ফিরতেই সবাই ছুটলো দোতলায় রথীনের ঘরের দিকে, শর্মিলার কান্নার আওয়াজটা যে ও দিক থেকেই আসছে।

মিহির আগে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল যাতে আর কেউ ঢুকতে না পারে। প্রত্যেকে ঘরের বাইরে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে দাঁড়ায়। রমেন আর রজনী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করছে। অবনী অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। কান্নার আওয়াজটা এখনো ভিতর থেকে আসছে। এমন অবস্থায় হটাৎ ঘরের দরজা খুলে গেল। ঝড়ো কাকের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মিহির, মুখে কোন রা নেই। অবনী চেঁচিয়ে উঠল, 'কেমন আছে দাদা?' মিহির এখনো নির্বাক, অবনী আওয়াজটা এবার আর একটু বেড়ে গেল, কি হলো ডাক্তারদা (অবনী মিহিরকে এই নামেই সম্বোধন করত), কথা বলছ না কেন?' এবার মিহির ধীরে ধীরে মুখ তুলল, তার চোখের জল যেন বাঁধন মানছে না। আর এর সাথে সাথে ই অবনী কান্নায় ভেঙে পরল।

দু'বছর, সাত মাস পর

কয়েকমাস পরেই প্রজাতন্ত্র দিবসের শতবার্ষিকী পালন করবে সারা দেশ। সুতরাং নিরাপত্তার কঠোর জাল বুনতে হবে আর সেই সঙ্গেই জঙ্গি সংগঠন, জঙ্গি নেতা ও তাদের সাহায্যকারী প্রত্যেকের উপর নজর রাখতে হবে। এই সময়টাকে অত্যধিক স্পর্শকাতর বলে ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের। তাই রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তরে নিজের কেবিনে গোয়েন্দা আধিকারিকদের নিয়ে এক জরুরী মিটিং করছেন গোয়েন্দা অফিসার সনাতন মিত্র। ছিপছিপে ও শক্তপোক্ত চেহারা, উচ্চতা তা প্রায় পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি, গায়ের রং চাপা, চোখে একটা অদ্ভুত চপলতা। অপরাধীদের ত্রাস এই গোয়েন্দা অপরাধী ও পুলিশ উভয় মহলেই পরিচিত 'চিপকু গোয়েন্দা' বলে, কারণ অপরাধের শিকড় আর অপরাধী পর্যন্ত না পৌঁছানো পর্যন্ত কেসের সাথে জোঁকের মতো লেগে থাকে। এই নামটা অবশ্য সনাতনের অপছন্দের নয়। সনাতন গর্ব করে বলে "মানিকবাবু আমাদের রক্তে গোয়েন্দাগিরি ঢুকিয়ে দিয়েছেন, অন্ততঃ তাঁর প্রতি সম্মান জানাতে 'চীনা জোঁক' কেসের সাথে তো লেগে থাকতেই হবে।"
মিটিং-এর মাঝেই মোবাইল বেজে উঠল, বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা দেখে দ্রুত ফোনটা রিসিভ করলেন - "জয় হিন্দ স্যার" "স্যার, অফিসেই আছি" "এখুনি?" "কিন্তু স্যার আমি এই মুহূর্তে যে অফিসারদের নিয়ে জরুরি একটা মিটিং করছি......" "ঠিক আছে স্যার, এখুনি আসছি"
ফোনটা কেটে কয়েক মুহূর্ত কিছু ভাবল, তারপর বলল "মাই ডিয়ার অফিসার্স, আওয়ার মিটিং ইজ ওভার, আপনারা এখন আসতে পারেন, আমি পরে সময় মতো আবার কল করে নেব।" সবাই বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো এমন সময় সনাতন বলল, "অভি, তুমি দাঁড়াও।"
আভি অর্থাৎ অভিরূপ চট্টপাধ্যায়, আইপিএস অফিসার, বয়স ৩৩ বছর। বুদ্ধিদীপ্ত এই অফিসার দারুণ কর্মঠ আর তাই চিপকু গোয়েন্দার পছন্দের তালিকায় একদম শীর্ষে পৌঁছাতে সময় লাগেনি।
অভিকে বসতে নির্দেশ দিলেন সনাতন। অভি, ডিআইজি স্যারের ওখান থেকে ফোন এসেছিল, আমাকে সমস্ত এপয়েন্টমেন্ট, এসাইনমেন্ট ক্যানসেল করে ইমিডিয়েট ওনার অফিসে পৌঁছাতে বললেন। এতো উদ্বেগে স্যারকে কখনো দেখিনি। কি সমস্যা হতে পারে বলো তো?"
স্যার আমি... মানে.....আমি...." অভিকে আমতা আমতা করতে দেখে থামিয়ে দিয়ে সনাতন বলল "তুমিই বা কি করে জানবে?" দীর্ঘশ্বাস নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সনাতন, "অভি, চলো আমার সাথে।"
"স্যার আমি? কিন্তু উনি তো আপনাকে ডেকেছেন!"
"কথা না বাড়িয়ে চলো তো আমার সাথে"

"স্যার আসতে পারি?" কেবিনের দরজাটা ঠেলে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল সনাতন।
"আরে, এসো-এসো, বসো" বলে চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে বসতে বলল ডিআইজি সত্যসাধন মুখোপাধ্যায়।
"স্যার আমি কিন্তু আভি মানে অভিরূপকেও নিয়ে এসেছি।"
"তা বেস তো, ওকে ভিতরে ডাকো"
"অভি ভাতরে এসো"
অভি ভিতরে ঢুকে স্যালুট জানাল, তারপর পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল।
"দাঁড়িয়ে কেন! বোসো।" অভিকে ডিআইজি বললেন।
"থ্যাংক ইউ স্যার" বলে অভি সনাতনের পাশের চেয়ারে বসল।
এরপর কয়েক মিনিটের পিনড্রপ সাইলেন্স। ডিআইজিকে বেশ চিন্তিত লাগছে। মাথার পিছনে হাত দিয়ে শরীরটা চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে কি যেন ভাবছে।
"স্যার! আপনাকে এতো চিন্তিত আগে কখনো দেখিনি।" "বিশেষ কোন টেরোরিজম মুভমেন্টের খবর আছে?"
"হুম! এটা টেরোরিস্টই বটে, অতি ভয়ঙ্কর টেরোরিস্ট"
"কোন গ্রুপ স্যার?" "বোম ব্লাস্টের পরিকল্পনা আছে না অন্য কিছু?"
"নাহ্ সে সব কিছু নয়। আচ্ছা সনাতন তোমার বয়স কতো হলো?"
"স্যার, একচল্লিশ প্লাস"
"বাঃ, তাহলে তো তোমার মনে থাকার কথা।"
"কি বলুন তো স্যার!"
"বছর সাতাশ-আঠাশ আগে একটা ভাইরাস মহামারীর রূপ নিয়েছিল ফলে সারা বিশ্ব সন্ত্রস্ত হয়ে গিয়েছিল, মনে পড়ে?"
"খুব মনে পরে স্যার, আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি, বহুদিন স্কুল বন্ধ ছিল, আমাদের তো খুব মজা হয়েছিল।"
"কিন্তু কতো মানুষের কতো ক্ষতি হয়েছিল চিন্তা করোতো, দেশের অর্থনীতির একেবারে তলানিতে চলে গিয়েছিল। যাইহোক, অভি তোমার মনে পড়ে কিছু?"
"স্যার আমার তখন বয়স ছ'বছর, সেভাবে কিছু মনে নেই, তবে পরে এ ব্যপারে অনেক গল্প শুনেছি। কিন্তু স্যার আজ সে সব কথা কেন উঠছে ঠিক বুঝলাম না।"
ডিআইজির চোখ দুটো কুঁচকে গেল, টেবিলের উপর ঝুঁকে পরে বলল, "যদি সে আবার ফিরে আসে?"
"মানে! কি বলছেন স্যার?" সনাতন চমকে উঠল।
"হ্যাঁ, তুমি ঠিক শুনেছ, গত পরশু আরএন রায় গ্রুপ অফ কোম্পানিজের মালকিন শর্মিলা রায়ে একমাত্র ছেলে রমেন্দ্রনাথ রায় মারা গেছে। ক'দিন ধরেই সে জ্বরে আক্রান্ত ছিল। ওর চিকিৎসা করছিল বিখ্যাত ভাইরোলজিস্ট ডাঃ প্রশান্ত সামন্ত। উনি নিশ্চিত যে রমেনের শরীরে ঐ ভাইরাস বাসা বেঁধেছিল। এই রোগ যদি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে তার ফল অতি ভয়ঙ্কর হবে। এটা আমাদের আটকাতেই হবে সনাতন। তোমার দুজনে একবার ওদের সাথে যোগাযোগ করো, ওদের বাড়ি গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে দেখ তবে সাবধান কেউ যেন কিছু জানতে না পারে। যতদিন না কোনো কনক্লুশনে পৌঁছাতে পারছি ততদিন এটা মানুষের স্বার্থেই গোপন রাখতে হবে। এই কেসটা আমি তোমার হাতেই তুলে দিলাম।"
"চিন্তা করবেন না স্যার, এই রোগ আমি ছড়াতে দেবো না। ঠিক আছে স্যার, আমি চলি"
"বেস্ট অফ লাক মাই বয়"
সনাতন আর অভিরূপ দুজনেরই ডিআইজির কাছ থেকে বিদায় নিল।

গাড়ি এসে থামল বিশাল সাদা বাড়িটার গেটে। দারোয়ান পরিচয় জানতে চাইলে সনাতন বলল "থানা থেকে আসছি। ম্যাডামের সাথে দেখা করতে চাই।" রাস্তায় আসতে আসতে অভিকে সনাতন বলে দিয়েছিল যে তারা যে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট থেকে আসছে তা যেন কেউ জানতে না পারে। বাড়িতে ঢুকতেই এক পরিচারক পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে অভি জানাল যে তারা থানা থেকে আসছে, ম্যাডাম শর্মিলার সাথে দেখা করতে চায়। পরিচারক তাদের উপরের নিয়ে গেল। ঘরে একদিকে পুত্রহারা শোকার্ত মাকে সান্তনা দিচ্ছে অবনী আর একদিন বন্ধুসম ভাইপোহারা বিলাপরতা পিসিকে বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে মিহির।
সনাতন দরজায় টোকা দিল, "আসতে পারি?"
"কে?" অবনী জিজ্ঞাসা করতেই ঘরের সবাই দরজার দিকে তাকাল।
"আমি সনাতন মিত্র, থানা থকে আসছি। ও আমার সহযোগি অভিরূপ চট্টপাধ্যায়। আমি রমেনের মৃত্যুর ব্যাপারে একটু খোঁজ খবর নিতে চাই।"
সবাই যেন চমকে উঠল, "কেন বলুন তো?" অবনী জানতে চাইল।
"না আসলে ওর মৃত্যু অজানা জ্বরের ফলে হয়েছে তো তাই আমাদের একটু রমেনের ব্যপারে খোঁজ খবর করতে বলা হয়েছে। আসলে রাজ্যে অজানা জ্বরে মৃতদের একটা ডাটাবেশ তৈরী করছে সরকার। সেই ব্যাপারেই কিছু প্রশ্ন করব আপনাদের, যদি আপনাদের কোনো আপত্তি না থাকে।"
মিহির বলল "না না আপত্তি থকবে কেন! আসুন, বসুন।"
তাদের বিভিন্ন প্রশ্ন করে সনাতন আর অভিরূপ যা জানতে পারল তা এইরকম---

রথীনের মৃত্যুর পড় তার ব্যবসা এখন বিধবা স্ত্রী শর্মিলা ও ভাই অবনী সামলাচ্ছে। শর্মিলা ঠিক করেছে যে রমেনের উচ্চমাধ্যমিক শেষ হলে তাকে অক্সফোর্ডে ভর্তি করবে, তাই অবনীকে এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য বলেছে সে। এদিকে রজনীও বিবাহযোগ্যা হয়েছে। শর্মিলা তার এক ব্যবসায়ী বন্ধুর ভাইয়ের সাথে রজনীর বিবাহ প্রস্তাব দিয়েছে, যদিও রজনীকে এতে খুব একটা খুশি মনে হয় নি কিন্তু মুখে কোনো আপত্তি করেনি। তাই শর্মিলাও আর বেশি দূর এগোয় নি।

সামনে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা তাই রমেন দিনরাত এক করে পড়াশোনা করছে। এরপর বিদেশে যাবে, অক্সফোর্ডের মতো এক বিশ্ব বরেণ্য ও ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবে, এসব ভাবলে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হবে, ভালো রেজাল্ট না হলে অক্সফোর্ডে ভর্তি হওয়া হবে না। তাই সে নাওয়া খাওয়া ভুলে পড়াশোনা করতে ব্যস্ত। মা একদিন বলেছিলেন, "হ্যাঁ রে, এই ভাবে বই মুখে পরে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে পরবি!" জবাবে রথীন বলেছিল, "ও কিছু হবে না, অক্সফোর্ডের টিকিট পেতে একটু কষ্ট তো করতেই হবে মা, বাবার ইচ্ছা যে পুরন করতেই হবে। তুমি চিন্তা কোরো না।" জবাব শুনে মা খুশি হয়ে চলে গিয়েছিল।

এবার অক্টোবরে শেষ সপ্তাহেই শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পরেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে এমনটা দেখা যায় নি। এর মধ্যেও রমেন এসি চালিয়ে পড়তে বসে। বাড়ির সবাই মানা করলেও সে কি মানার ছেলে! "বৌদি,রাত প্রায় এগারোটা বাজতে চলল, এখনো রমেন খেতে এলো না?" শর্মিলা রজনী জিজ্ঞাসা করতেই রজনী বলল দাঁড়া আমি দেখছি, এই বলে তিনতলার উপরে রমেনের পড়ার ঘরে গেল। ঘরে ঢুকে শর্মিলা দেখে রমেন ঘুমোচ্ছে। "দেখ ছেলের কান্ড, আমরা নিচে অপেক্ষায় আছি ও কখন পড়াশোনা শেষ করে খেতে আসবে আর ছেলে আমার লেপ ঢাকা দিয়ে ঘুমোচ্ছে" এই বলে রমেনের গায়ে হাত দিতেই শর্মিলা চমকে উঠল। এ কি! গা যে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে! সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার মিহিরের ডাক পরল। ডাক্তার এলেন, জ্বর মাপার জন্য থার্মোমিটারটা রমেনের বগলে লাগিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "ওর কি কাশি বা হাঁচি হচ্ছে?" উত্তরে রজনী বলল, "ক'দিন ধরে খুক খুক করে কাশছে, বৌদি রেগে গিয়ে ওর ঘরের এসির কানেকশনটা কেটে দিয়েছে।" কি! এখনো ও এসি চালাচ্ছে!" আশ্চর্যজনক অভিব্যক্তি সহ জিজ্ঞাসা করল মিহির আর তারপর ওষুধ পত্র দিয়ে চলে গেল। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল এখনো জ্বর ছাড়ছে না। অবনী, শর্মিলা আর রজনী আলোচনা করছিল। বাড়ির সকলে যথেষ্ট উদ্বেগের মধ্যে আছে। ঘর পোড়া গরু তো, সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় তো পাবেই। এমন সময় রজনীর মোবাইলে একটা ফোন এলো। "ছোটো মামা ফোন করেছেন, তাড়াতাড়ি ফোনটা ধর" বলে শর্মিলা রজনীর দিকে ফোনটা এগিয়ে দিল।
"হ্যালো, হ্যাঁ মামা বলো"
"কিরে, ওদিককার কি খবর?" "রমেনের শরীর কেমন আছে?"
"একদম ভালো নেই মামা" রজনী মাথাটা নামাল
"জ্বর কি একটুও কমেছে?"
"না, আমার ভয় করছে! দাদাও তো.........." এই বলেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল রজনী।
"ভয়ের ব্যাপার তো বটেই, তবে কাঁদিস না, আমি কালই আমার বন্ধু বিখ্যাত ভাইরোলজিস্ট ডাঃ প্রশান্ত সামন্তকে নিয়ে যাব। চিন্তা করিস না।"
"ঠিক আছে মামা, তুমি কিন্তু কালই নিয়ে এসো"
"অবশ্যই; ঠিক আছে এখন রাখছি।"
"কিরে রজনী, মামা কি বললেন?" অবনী উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করল। রজনী অবনী আর শর্মিলাকে মামার সাথে হওয়ার কথাবার্তা সংক্ষেপে জানাল। অবনী আপত্তির সুরে বলল, "এই সামান্য জ্বরের জন্য এতো নাম করা ডাক্তার আনার কি দরকার, মিহিরদা তো আছেই।" রজনী বলল, "না অবনীদা আমার ভিষন ভয় করছে, মামা বড় ডাক্তার নিয়েই আসুক।"

পরদিন সকালেই ছোটো মামা ডাঃ সামন্তকে নিয়ে হাজির। বাড়িতে এসেই সোজা রমেনের ঘরে চলে গেল। ডাঃ সামন্ত রমেনকে প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে পরীক্ষা করার পর নিচে নেমে এলো। মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। কপালে বলি রেখা দেখা যাচ্ছে। "আমি একটু ডাঃ চৌধুরীর সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চাই" ডাঃ সামন্তকে বললেন। 'ওহ্ সিওর, চলুন" বলে মিহির ডাঃ সামন্তকে পাশের ঘরে নিয়ে গেল।
"ডক্টর, আপনি তো শুরু থেকেই চিকিৎসা করছেন, তা আপনার কি মনে হয়?"
"আমি তো শুরুতে নর্মাল ভাইরাল ফিভার ভেবেছিলাম, কিন্তু কাল ওর সিম্পটমগুলো দেখে এটাকে আরও সিরিয়াস ভাবেই ট্রিট করছি। ইন ফ্যাক্ট আমি আজকে ওর কিছু টেস্ট করানোর কথাও ভেবেছিলাম। সকালে এখানে এসে শুনলাম আপনি এসেছেন। ভালোই হলো। আপনার কি মত স্যার?"
"আমি কিন্তু খুব একটা ভালো বুঝছি না। নর্মাল ভাইরাল ইনফেকশন বলে মনে হচ্ছে না। তাই আমি ওকে আমার হাসপাতালে শিফ্ট করতে চাই, অবশ্য যদি আপনার আপত্তি না থাকে।"
"একি বলছেন স্যার! আপনার মতো স্বনামধন্য ডাক্তার ওর চিকিৎসা করবে এতে আমার আপত্তি কেন থাকবে? রমেন তো আমার ছেলের মতোই। আপনি ওকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।"
কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির হলো। দ্রুত রমেনকে নিয়ে যাওয়া হলো রাজ্যের এক নামকরা হাসপাতালে যার ভাইরোলজি ডিপার্টমেন্টের যথেষ্ট সুখ্যাতি আছে। চিকিৎসাও দ্রুত শুরু হয়ে গেল। রক্ত, মল, মূত্র, লালারস ইত্যাদি নানান নমুনা টেস্টের জন্য ল্যাবে পাঠানো হলো কিন্তু রমেন সতেরো বছরের এই কোমল শরীর ঐ আর পেরে উঠল না। সেদিন রাতে রমেন মারা গেল।

জিজ্ঞাসাবাদ করে অফিসে ফেরার জন্য গাড়িতে উঠল সনাতন আর অভিরূপ। কিছুদূর যেতেই সনাতনের মোবাইলটা বেজে উঠল। ডিআইজি সত্যসাধন মুখোপাধ্যায়ের কল, সনাতন ফোনটা ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে কিছু নির্দেশ এলো আর সনাতন "ওকে স্যার" বলে ফোনটা রেখে দিল।
"কি ব্যাপার স্যার?" অভি জিজ্ঞাসা করল।
"ডাঃ সামন্ত আমার সাথে দেখা করতে চান, উনি আজ বিকেলে সাড়ে তিনটে নাগাদ স্যারের অফিসে আসবেন। এখন ক'টা বাজে অভি?"
"স্যার, দেড়টা বাজে"
"হাতে বেশিক্ষণ সময় নেই, লাঞ্চ করেই বেরিয়ে পরতে হবে।"


                                                                                     অঙ্কন ; তন্দ্রা ব্রহ্মচারী 

বিকাল ঠিক তিনটে পঁচিশে সনাতন আর অভি পৌঁছে গেল ডিআইজির অফিসে।
"স্যার আসতে পারি?" সনাতন কেবিনে ঢোকার অনুমতি চাইল।
"আরে অতো ফর্মালিটির দরকার নেই, এসো এসো"
ভিতরে ঢুকে দুজনেই স্যালুট করে চেয়ারে বসল।
"মিসেস রায়ের সাথে কথা হলো?"
"হুম, স্যার হলো তবে শুধু মিসেস রায় নয় ওনার দেওর, ননদ ও ওনাদের পারিবারিক ডাক্তার মিহিরবাবুর সাথেও কথা হয়েছে।"
"ফাইন! কি জানতে পারলে?"
সনাতন সংক্ষেপে পুরো ঘটনাটা ডিআইজিকে জানাল। এই কথা শেষ হতেই ডাঃ সামন্ত সেখানে এসে পৌঁছলেন।
"গুড আফটারনুন ফ্রেন্ডস্"
"গুড আফটারনুন ডক্টর, আসুন আসুন। প্লিজ হ্যাভ ইওর সিট।"
"থ্যাংক ইউ। তবে আমি সিওর নই এই আফটারনুনটা গুড না ব্যাড" চেয়ারে বসতে বসতে বললেন ডাঃ সামন্ত।
"ডক্টর, এই হলো সনাতন মিত্র, আমাদের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টর রত্ন বলতে পারেন। আর এই ইয়ংস্টারের নাম অভিরূপ চট্টপাধ্যায়, সনাতনের অন্যতম প্রিয় সহযোগি। আর সনাতন ইনি ডাঃ সামন্ত।"
করমর্দন করে পরিচয় পর্ব শেষ হতেই ডাঃ সামন্ত সনাতনকে উদ্দেশ্যে করে জিজ্ঞাসা করল, "অফিসার, আপনি তো রমেনের বাড়ি গিয়েছিলেন, পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বার্তাও বলেছেন তা রমেন কি ইদানীং বিদেশে কোথাও গিয়েছিল?"
"না, ইনফ্যাক্ট ও পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে নিজের ঘর থেকেই হয়তো মাস ছয়েক বের হয় নি।" সনাতন জবাব দিল।
"দেখুন ওর শরীর থেকে ভাইরাসটা যে পাওয়া গেছে এটা তো সত্যি কিন্তু প্রশ্ন হলো এই ভাইরাস ওর শরীরে এলো কোথা থেকে। এটা যে পর্যায়ে আছে তাতে ভয়ের কিছু নেই কারোর প্রাণ নিতে পারবে না কিন্তু যদি ভয় তখনই যদি এ মিউটেশনের মাধ্যমে নিজের ডিএনএ তে কোনো পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলে আর এটা হলে আবার মহামারী দেখা দেবে আমি নিশ্চিত।"
অভি জিজ্ঞাসা করল, "ডক্টর আপনি বললেন এর প্রাণ নেওয়ার ক্ষমতা নেই তাহলে রমেন কি করে মারা গেল?"
"ইয়ংম্যান এই একই চিন্তা আমিও করছি। একজন সুস্থ সবল যুবক কখনোই এর প্রভাবে মারা যেতে পারে না। বয়স্ক মানুষ হলে তবুও কথা থাকত কারন বৃদ্ধ/বৃদ্ধাদের ইমিউনিটি অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে।"
"অথবা যদি না ইচ্ছা করে, নির্দিষ্ট ওষুধ প্রয়োগ করে কারোর ইমিউনিটি কম করে দেওয়া হয়?" সনাতন জিজ্ঞাসা করল।
"মানে?" ডাক্তার চমকে উঠল।
"মানে ধরুন এই ভাইরাসটা কারোর শরীরে ইচ্ছাকৃত ভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো আর তারপর কোনো ওষুধ দিয়ে তার শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে দেওয়া হলো? ইজ ইট পশিবল?
"প্লান্ড মার্ডার! ডু ইউ নো........"
"স্যার আমি ভেবেচিন্তেই বলছি" ডিআইজির কথা শেষ হওয়ার আগেই উত্তর দিল সনাতন।
"ডক্টর সনাতন যা বলছে তা কি সম্ভব?" ডিআইজি ডাক্তার সামন্তকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করল।
"ইট ইজ থিওরিটিক্যালি পশিবল বাট নট প্রাক্টিক্যালি।" ডাক্তার জবাব দিল।
"হোয়াই নট প্রাক্টিক্যালি পশিবল?" ডিআইজি জিজ্ঞাসা করল।
"কারন এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়, গত পঁচিশ বছরে আমাদের দেশে বা বিশ্বের কোথাও এই ভাইরাসের আক্রমণের কোনো রেকর্ড নেই। কারোর পক্ষে এই ভাইরাস জোগাড় করাই সম্ভব নয়।" ডাক্তার বলল
"সনাতন বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দাও" বলে ডিআইজি সনাতনের দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিল।
"থ্যাংক ইউ স্যার" বলে সিগারেট নিয়ে সনাতন পকেট লাইটার বের করল। চিন্তিত মুখে সনাতন সিগারেটটা ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে উপর দিকে মুখ করে ধোঁয়া ছাড়ল। এরপর আর আর একটা টান দিতে যাবে এমন সময় সনাতনের চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো ও হালকা বিস্ফারিত হলো যেন অন্ধকার জঙ্গলে পথ হারানো ব্যক্তি দূরে কোনো আলোর ছটা দেখতে পেয়েছে আর তারপর জিজ্ঞাসা করল "ডাক্তারবাবু ভারতের কোথাও কি এই ভাইরাস নেই?"
ডাক্তার কিছুক্ষণ চিন্তা করল তারপর বলল, "একটা জায়গায় আছে, কোচিনের 'দ্যা ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি'-এর ল্যাবে, তবে সেখান থেকে নিয়ে আসা তো অসম্ভব।"
"হুম...... স্যার আমি আর একবার ও বাড়ি যেতে চাই, মে আই? সনাতন ডিআইজিকে জিজ্ঞাসা করল।
"অফ কোর্স। সনাতন তুমি এই কেসের ইনভেস্টিগেশন অফিসার, এই কেসের জন্য তুমি যতবার খুশি যেখানে খুশি যেতে পারো। তবে একটা কথা মাথায় রেখো যতক্ষণ না কোনো কনক্লুশনে পৌঁছাতে পারছি এই ভাইরাসের ব্যাপারে কেউ যেন কিছু জানতে না পারে।"
সিওর স্যার। আচ্ছা ডক্টর আমি যদি এই ইনভেস্টিগেশনের কাজে আইভি যেতে চাই তাহলে আপনি কি আমাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারবেন?"
"কেন নয়! ওখানকার ল্যাব ইন-চার্জ প্রফেসর ফার্নানডেজ আমার বিশেষ পরিচিত।"
"তাহলে আপনি এখুনি কথা বলে ব্যবস্থা করুন আমি কালই কোচিন যেতে চাই। অভি তুমি কাল একবার রায় বাড়ি যাও, চারিদিক ভালো করে খুঁটিয়ে দেখবে, বিশেষ করে রমেনের ঘরটা। বুঝেছ?" সনাতন এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল।
ডাক্তার সম্মতি সূচক ঘাড় নেড়ে উঠে পড়ল, "আমি তাহলে চলি?"
"ওকে ডক্টর। প্রয়োজন মতো কথা বলে নেব", ডিআইজি বলল।
"স্যার আমরাও উঠি?" ডিআইজির থেকে আজ্ঞা নিয়ে সনাতন আর অভি দুজনেই বেরিয়ে গেল।

ভোরের ফ্লাটেই সনাতন কলকাতা থেকে কোচিন এসেছে। এখানকার আবহাওয়া কোলকাতার থেকে বেশ আলাদা। কলকাতা ঠান্ডার আমেজ ইতিমধ্যেই চলে এসেছে কিন্তু এখানে এখনো বেশ গরম, ফ্লাইট থেকে বের হতেই যেন মনে হলো জ্বলন্ত ফার্নেস। এয়ারপোর্টটা শহর থেকে বাইরে। এয়ারপোর্ট থেকে শহরে আসার রাস্তাটার দু'দিক শুধুই সবুজ। এক সঙ্গে এতো সবুজ অনেক দিন পর দেখল সনাতন। এয়ারপোর্ট থেকে সনাতন সোজা ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি এসে পৌঁছল। ঘড়িতে এখন সকাল সাড়ে ন'টা বাজে। সকাল দশটায় প্রফেসর ফার্নানডেজ এপয়েন্টমেন্ট নেওয়া আছে। সনাতন প্রফেসর ফার্নানডেজকে ফোন করে ওর উপস্থিতর জানান দিলে প্রফেসর তাকে নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করতে বলল।

অভিকে ঠিক সময় মতো রমেনদের বাড়িতে উপস্থিত হলো। দারোয়ান আজ আর পরিচয় জিজ্ঞাসা করে নি। অভি গাড়ি থেকে নামতেই স্যালুট করে বলল, "সেলাম সাব। ঘর পর ম্যাডামজি কে আলাবা অউর কোহি ভি নেহি হ্যা। ম্যাডাম ভি দিন ভর রোঁ রহি হ্যা।" দারোয়ানের সাথে অভি কয়েকটা কথা বলে ভিতরে গেল। অভি বাড়িতে ঢুকতেই দেখল শর্মিলা বসার ঘরের দেওয়ালে টাঙানো রমেনের একটা বড় ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। অভি পিছন থেকে ডাকল, "ম্যাডাম..."

প্রফেসর ফার্নানডেজ কেবিনে ঢুকে সনাতন নিজের পরিচয় দিতেই প্রফেসর সনাতনকে বসতে বললেন। সনাতন ধন্যবাদ জানিয়ে বসল।
"প্রফেসর, আপনার সাথে তো ডক্টর সামন্তর কথা হয়েছে, উনি নিশ্চিয় আপনাকে সব বলেছেন?"
"হ্যাঁ-হ্যাঁ, উনি আমাকে সবটা বলেছেন। উনি এও বলেছেন যে আপনি সন্দেহ করছেন যে এটা একটা প্লানড্ মার্ডার হতে পারে।"
"হ্যাঁ, একেবারেই তাই। আচ্ছা আপনারা কি ইদানীং কাউকে কোনো কারনে এই ভাইরাস দিয়েছেন?"
"ইনসপেক্টর, আমাদের ল্যাবে যে ভাইরাসগুলো আছে তাদের মধ্যে এটাই সব থেকে বিপজ্জনক। কেউ চাইলেই তো আর তাকে এই মারণ বিষ দিয়ে দিতে পারি না। এর একটা নির্দিষ্ট প্রটোকল আছে। আমাদের ডাটাবেসে সব রেকর্ড থাকে।"
"তাহলে আমাকে কি গত এক বছরের ডাটা দিতে পারেন প্রফেসর?"
"দেখুন ইনসপেক্টর আমি আগেই বলেছি আমরা একটা নির্দিষ্ট প্রটোকলে বাঁধা আছি, তাই উইদাউট এনি অফিশিয়াল করেসপন্ডেন্স আমি এ ব্যাপারে আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারব না।"
"কিন্তু প্রফেসর কোনো রকম অফিশিয়াল করেসপন্ডেন্স করতে গেলে তো সব কিছু ফ্লাস হয়ে যাবে! ব্যাপারটা আর গোপন রাখা যাবে না।"
"ইনসপেক্টর, দেন আই এম হেল্পলেস, এক্সট্রিমলি সরি ফর দ্যাট।"
"প্রফেসর, প্লিজ ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝুন। আমি কিন্তু অনেক আশা নিয়ে এতো দূর এসেছি।"
প্রফেসর কিছুক্ষণ চিন্তা করল তারপর বলল, "আপনাকে একটা হেল্প করতে পারি। তবে আনঅফিশিয়ালি, তাতে আশাকরি আপনার পারপাশ সল্ভ হবে, তদন্তের কাজে আসবে।"
"কি ভাবে?" সনাতন প্রফেসরকে জিজ্ঞাসা করল।
"আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি, আপনি নোট করে নিন।" প্রফেসর জবাব দিল।
কম্পিউটারের ডাটা চেক করে প্রফেসর একটু অবাক হলো তারপর সনাতনকে জানাল যে গত প্রায় চার বছর কেউ এই ভাইরাসের নমুনা এখান থেকে নেয় নি।
এটা শুনে সনাতন চিন্তিত হয়ে পরল। তারপর প্রফেসরকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে পরল।

গাড়ি এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য অপরূপ। কিন্তু সনাতনের এসব কিছুই ভালো লাগছিল না, যেতে যেতে সে শুধু ভাবছিল যে এতদূর কষ্ট করে এলো আর তার কোনো ফল পেলো না! ঠিক সেই সময় সনাতনের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল।
"হ্যালো! ইয়েস প্রফেসর টেল মি।"
ফোনের ওপার থেকে প্রফেসর কিছু বলল আর তারপর সনাতনের মুখটা খুশিতে ভরে উঠল। প্রফেসরকে ধন্যবাদ জানিয়ে সনাতন ফোন রেখে দিল।

সনাতন এয়ারপোর্ট থেকে সোজা অফিসে চলে এলো। অভি ওর জন্য অপেক্ষা করছিল, সনাতন নিজের কেবিনে ঢুকতেই অভি উঠে দাঁড়াল।
"বোসো, বোসো। আর এদিকের কি খবর অভি?"
"স্যার আমি রায় বাড়ি গিয়েছিলাম। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি।"
"বাঃ! তবে তথ্য তুমি পেয়েছ ঠিকই কিন্তু তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার বিচার আমিই করব" বলে সনাতন হাসল। "বলো কি কি তথ্য তুমি পেয়েছ।"
"স্যার প্রথমত, দারোয়ানের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি যে ওদের পারিবারিক ডাক্তার মিহিরবাবুর সাথে রমেনের পিসি রজনীর একটা প্রেমের সম্পর্ক আছে আর এর প্রমান আমি মিহিরবাবুর মোবাইলের কল হিস্ট্রি থেকেও পেয়েছি। দ্বিতীয়ত, রথীনবাবুর উইল অনুযায়ী আঠারো বছর বয়স হলেই এই সমস্ত সম্পত্তির মালিক হতো রমেন। তৃতীয়ত, আমি রমেন ঘরে একটা ওষুধের ছেঁড়া র্যাপার পেয়েছি যে ওষুধটা সাধারণত ফাঙ্গাল ইনফেকশনের জন্য ব্যবহার করা হয় কিন্তু মোস্ট ইম্পর্টেন্টলি এই ওষুধটার সাইড এফেক্টে ইমিউনিটি সিস্টেমের বারোটা বেজে যায়, তবে মিসেস রায়ের সাথে কথা বলে জেনেছি যে ঐ পরিবারের কারোর কোনো রকম ফাঙ্গাল ইনফেকশনের কোনো হিস্ট্রি নেই। তাহলে এই ওষুধটার কি কাজ?"
"তুমি তো কামাল করে দিয়েছ হে! আমিও হয়তো এতটা সাফল্য পেতাম না। আচ্ছা অভি তোমার কি কাউকে সন্দেহ হয়?"
অভি একটু চিন্তা করল তারপর বলল "না স্যার, আমি তো কাউকে সন্দেহ করতে পারছি না।"
"অভি, একজন সাকসেসফুল গোয়েন্দা হতে গেলে তোমাকে সন্দেহবাতিক হতেই হবে। সন্দেহ করতে শেখো হে।"
"অবশ্যই স্যার। মনে থাকবে। স্যার ওখান থেকে কি ইনফরমেশন পেলেন?"
"প্রথমত কিছুই পাই নি তবে পরে প্রফেসর ফার্নানডেজ ফোনে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। আমি সেটা নিয়েই চিন্তিত ছিলাম কিন্তু তুমি দুই আর দুই চার মিলিয়ে দিলে।"
"আপনি কি ডাক্তার মিহিরকে সন্দেহ করছেন নাকি?"
"আচ্ছা অভি, রথীনবাবু কবে মারা যান?"
"তা স্যার বছর তিনেক হবে।"
"হুম..... অভি আমার বিশ্বাস ওটাও মার্ডার।"
"কি বলছেন স্যার!" অভি অবাক হয়ে সনাতনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
"ইয়েস মাই ডিয়ার, আই এম কোয়াইট সিওর এবাউট দ্যাট।"
"চলো ওঠো এখুনি বেরোতে হবে"
গাড়িতে উঠে অভি সনাতনকে জিজ্ঞাসা করল, "কিন্তু স্যার আমরা যাচ্ছি কোথায়?"
"প্রাইম সাসপেক্টকে তুলে আনতে। আমি কাকে মিন করছি তুমি কি বুঝলে?"
"স্যার, লেট মি গেস; ডক্টর মিহির চৌধুরি?"
"এই তো তোমার মগজাস্ত্র কাজ করছে! ব্রাভো মাই বয়।"
"কিন্তু স্যার আইভি থেকে আপনি কি তথ্য পেলেন তা কিন্তু আমাকে এখনো আপনি জানালেন না" অনুযোগের সুরে অভি বলল।
"এতোই যখন তোমার কিওরিসিটি তবে শোনো-
আমি যখন প্রফেসর ফার্নানডেজের কাছ থেকে নিরাশ হয়ে ফিরছি তখন রাস্তায় হটাৎ ওনার ফোন এলো উনি জানালেন বছর তিনেক আগে এখানকার এক মেডিকেল কলেজের অধিকর্তার সুপারিশে ডঃ এম আর চৌধুরি নামের এক ডাক্তার নিজেকে ভাইরোলজিস্ট পরিচয় দিয়ে চারটে স্যাম্পল ওখান থেকে কালেক্ট করেছিলেন, উনি নাকি এই ভাইরাসটার উপর কোনো রিসার্চ করছেন। এই এম আর চৌধুরিই হয়তো মিহির রঞ্জন চৌধুরি আর মোটিভ তো তুমি দিয়েই দিলে।"

সনাতনদের গাড়িটা একটা বড় সোসাইটির গেটে এসে থামল। সিকিউরিটি গার্ডকে সনাতন নিজের পরিচয় দিয়ে মিহিরের ফ্লাট নম্বর জিজ্ঞাসা করল। চোদ্দ তলায় বিরাট ডুপ্লেক্স ফ্লাট। দরজায় বার কতক বেল বাজানোর পর মিহির দরজা খুলল। মিহির একটু অবাক হলো, "আপনি!"
"নমস্কার মিহিরবাবু। আমার সাথে তো আপনাকে কালই পরিচয় হয়েছিল।"
"নমস্কার, হ্যাঁ-হ্যাঁ মনে পরেছে। আসুন না, ঘরে আসুন।" মিহির অভ্যর্থনা জানাল
"না মিহির বাবু, আমি যাব না, বরং আপনাকে একটু আমাদের সাথে যেতে হবে।"
"কোথায়?"
"পুলিশ হেড কোয়ার্টার মানে আমার অফিসে"
"আমার অপরাধ?"
"আপাতত আপনি কিছু অপরাধ করেছেন তো আমি বলছি না।"
"ঠিক আছে, চলুন"

অফিসে নিজের ঘরে না গিয়ে সনাতন মিহিরকে নিয়ে একটা কনফারেন্স হলে গেল। কনফারেন্স টেবিলের এক দিকে সনাতন ও অভি আর অপর দিকে মিহির বসে বসল। বেয়ারাকে ডেকে সনাতন চা দিতে বলল। বেয়ারা চা দিয়ে গেলে সনাতন মিহিরের দিকে একটা কাপ এগিয়ে দিয়ে নিজের কাপে একটা চুমুক দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। এতক্ষণ মিহির চুপ ছিল, এবার মুখ খুলল, "ইনসপেক্টর, আমি কিন্তু আমার অপরাধ এখনো জানতে পারলাম না!"
"দেখুন মিহির বাবু আমার কাছে আপনার বিরুদ্ধে যা প্রমান আছে তা আপনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা বের করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আমি তা করি নি। কারণ আমি চাই না তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই ব্যাপারে কেউ কিছু জানুক। তাই আমি আশা করছি আপনি আমাদের সম্পূর্ণ সাহায্য করবেন। কি তাই তো?"
"কি মুশকিল! আপনি এতো কথা বলছেন আর আসল কথাটা কেন বলছেন না?"
"আপনার বন্ধুর ছেলে রমেনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয় নি। ও খুন হয়েছে।"
"কি বলছেন ইন্সপেক্টর! রমেনকে খুন করা হয়েছে!"
"আজ্ঞে হ্যাঁ। আর শুধু রমেন নয় আপনার বন্ধু রথীনবাবুও খুন হয়েছিলেন।"
"হোয়াট? ইমপসিবল। আপনি হয়তো জানেন না যে রথীনের ডেথ সার্টিফিকেট আমি দিয়েছিলাম ইনসপেক্টর।"
"আমি সবই জানি। আমি এও জানি আপনি কি ভাবে কোন অস্ত্রে ওদের হত্যা করেছেন। আমি এও জানি এর পিছনে আপনার উদ্দেশ্যে কি।"
"হোয়াট দ্যা হেল ইউ আর টকিং! আপনি জানেন রথীন আমার কাছে নিজের মায়ের পেটের ভাইয়ের থকেও আপন ছিল আর রমেন তো আমার নিজের ছেলের মতো। ওদের এতোটুকু ক্ষতি করার কথা কখনো আমি সপ্নেও ভাবতে পারি না আর আপনি বলছেন আমি খুন করেছি! আর তাছাড়া এতে আমার কি লাভ?"
"ডক্টর, মোটিভ তো নিশ্চয়ই আছে। আপনার সাথে রজনীদেবির সম্পর্কের কথা আমাদের অজানা নয়। আর এই সম্পর্কে রথীনবাবুও সহমত হলে আপনি নিশ্চয়ই এতো দিন অবিবাহিত থাকতেন না? আর রমেনের মৃত্যুর পর তো এই বিরাট সম্পত্তি আপনার পদতলে চলে এলো। কি ডক্টর?"
"ছিঃ ইনসপেক্টর ছিঃ! আমি তো এতোটা নিচ চিন্তা কখনো করতেই পারি না। আর তাছাড়া আমার আর রজনীর সম্পর্কের কথা রথীন তো জানতই না।"
"দেখুন মিহিরবাবু, আপনি তদন্তে আমাদের সাহায্য করলে আপনারই উপকার হবে, অন্যথায় আপনাকে আমরা গ্রেফতার করতে বাধ্য হব।"
"গ্রেফতার আপনি আমাকে করতেই পারেন, তাই বলে তো মিথ্যাটা সত্যি হয়ে যাবে না।"
এবার সনাতনের গলার স্বর উপর উঠল, উত্তেজিত গলায় চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, "আপনি বছর তিনেক আগে কোচিনের ইন্সটিটিউট অব ভাইরোলজি থেকে নিজেকে ভাইরোলজিস্ট পরিচয় দিয়ে একটা ভাইরাসের চারটে স্যাম্পল নিয়ে আসেন নি?"
"না ইনসপেক্টর না। আমি জীবনে কখনো কোচিন যাই নি আর ঐ ইন্সটিটিউট অব ভাইরোলজির তো কখনো নামই শুনিনি", মিহিরও উচ্চস্বরে উত্তর দিল।
"এখনো মিথ্যা কথা বলছেন! আমার কাছে এর রেকর্ড আছে যেখানে পরিস্কার যে ভাইরোলজিস্ট ডক্টর এম আর চৌধুরি অর্থাৎ আপনি চারটে স্যাম্পল কালেক্ট করেছেন।"
"বাঃ, এই বুদ্ধি নিয়ে আপনি নাকি রাজ্যের সেরা গোয়েন্দা! এমন গোয়েন্দা দপ্তরের উপর আমার সমবেদনা রইল। ডক্টর এম আর চৌধুরি কি আর কেউ থাকতে পারে না এই দেশে?"
মিহিরের কথাগুলো সনাতনের বুকে তীরের মতো বিঁধল। তাই তো এটা তো তার চরম বোকামি হয়েছে। শামুককে ছুঁয়ে দিলে শামুক যেমন নিজেকে খোলসের ভিতর ঢুকিয়ে নেয় সনাতনও ঠিক তেমন চুপসে গেল। চেয়ারে ধপ করে বসে পরল। মিহির তখনো উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা। সনাতন একটা সিগারেট ধরাল, দুটো লম্বা টান দিল তারপর মিহিরকে বলল, ডক্টর, আপনি আসতে পারেন। তদন্তের প্রয়োজন মতো আপনাকে আবার ডেকে নেব।"
মিহির বিধ্বস্ত অবস্থায় উঠে দাঁড়াল তারপর ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। "ডক্টর", সনাতনের ডাকে মিহির থমকে দাঁড়াল, "আপনার কাছে অনুরোধ, দয়া করে এ ব্যাপারে কাউকে কিছু জানাবেন না। এটা অত্যন্ত সংবেদনশীল ঘটনা এই মুহূর্তে এই ঘটনাটা গোপন রাখাই বাঞ্ছনীয়।"
মিহির সম্মতি সূচক ঘাড় নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

মিহির চলে যাওয়ার পর থেকেই সনাতন চুপ করে বসে ছিল, কোনো কথা বলেনি, গভীর চিন্তায় মগ্ন। অভি কয়েকবার ডেকেও সাড়া পায় নি তাই সে আর বৃথা চেষ্টা না করে অপেক্ষা করাই শ্রেয় মনে করেছে। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ নিজের কেবিন থেকে সনাতন বেরিয়ে এলো। বাইরে তখন অভি পায়চারি করছিল। অভিকে দেখে সনাতন বলল, "কি ব্যাপার অভি, এখনো বাড়ি যাও নি?"
"স্যার, আমি আপনারই অপেক্ষায় ছিলাম।"
"নাহ্ অভি, তোমার বৈবাহিক জীবনের বলি আমার হাতেই হবে মনে হচ্ছে, হা হা হা......"

সকাল সাতটা বাজে, অভি চায়ের কাপটা নিয়ে ট্যাবলেটে খবরের কাগজটা খুলে বসেছে। কাল রাতে বাড়ি ফিরতে রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছিল। না, অভির বৌ মালিনী অবশ্য এ নিয়ে কোনো অভিযোগ করেনি। ফ্রেস হয়ে খাওয়া দাওয়া করে শুতে শুতে রাত প্রায় একটা, তাই আজ উঠতে একটু দেরি হয়ে গেছে। হটাৎ ফোনটা বেজে উঠল। "এই যে সনাতনদা ফোন করেছেন, ধরো", মালিনী অভিকে ফোনটা দিয়ে গেল।
"হ্যালো! বলুন স্যার"
"অভি, তুমি আধ ঘণ্টার মধ্যে তোমার বাড়ির কাছে যে শপিং মলটা আছে তার সামনে এসে দাঁড়াও।"
"ওকে স্যার" বলে অভি ঝটপট তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়ল।

অভি গাড়িতে উঠেছে অনেকক্ষণ হলো কিন্তু সনাতন গত রাতের মতোই নিশ্চুপ। ধৈর্য হারিয়ে অভি সনাতনকে জিজ্ঞাসা করল, "স্যার, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?" সনাতন এখনো চুপ।
"বুঝলে অভি, গতকাল আমি একটা বড় ভুল করে ফেলেছিলাম। মিহিরবাবুর শেষ কয়েকটা কথা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছে।"
"কেন স্যার? আপনি কি ভুল করেছেন? আর ক্রিমিনালরা তো এরকম কতো কথাই বলে থাকে।"
"তুমি সিওর যে মিহিরবাবুই আসল খুনি? ডক্টর এম আর চৌধুরি এবং ডক্টর মিহির রঞ্জন চৌধুরি দুজন কি একই ব্যাক্তি?"
অভির চোখ দুটো বিস্ফারিত হলো, অবাক হয়ে বলল, "মানে! দুজন কি আলাদা ব্যক্তি?"
"আমি জানি না। তবে সেটা জানতেই এখন বেরিয়েছি।"

গাড়ি এসে দাঁড়াল একটা বড় তিনতলা বাড়ির সামনে। সনাতন আর অভিরূপ গাড়ি থেকে নেমে লোহার গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকল। সনাতন দরজার বেল বাজাল। অভি লক্ষ্য করল দরজায় বড় বড় করে লেখা আছে 'ডাঃ প্রশান্ত সামন্ত'।
এক পরিচারক তাদের ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসাল।বসার ঘরে দুজনে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতেই ডাঃ সামন্ত এলেন, "আরে সনাতন বাবু যে! একেই হয়তো সিক্সথ সেন্স বলে, আমি আজই আপনাকে ফোন করতাম। একটা ইমপরট্যান্স ইনফরমেশন আছে।"
"তাহলে ডক্টর আপনারটাই আগে শুনি, তারপর না হয় আমি যেটা বলতে এসেছিলাম সেটা বলব।"
"রমেনের শরীরে যে ভাইরাসটা পাওয়া গেছে তার জিনোম সিকোয়েন্সের আইভি তে সংরক্ষিত ভাইরাসের সাথে হুবহু মিল আছে তবে এর বাইরের যে প্রটিন এনভেলপটা আছে তা তুলনায় খুবই দুর্বল। অর্থাৎ ঐ ভাইরাসের উপর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়োগ করা হয়েছে আর এর ফলে ভাইরাসটা দুর্বল হয়ে পরেছে আর এর এক শরীর থেকে অন্য শরীরে ছড়িয়ে পরার ক্ষমতাও কমে গেছে। ফলে এর থেকে মহামারীর কোনো আশংকা নেই।"
"তার মানে অনেক পরিকল্পনা করে তবেই রথীনবাবুর ও রমেনের উপর এই বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে?" অভি ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলল।
"আচ্ছা ডক্টর, আপনি কি ডাঃ মইনুল হোসেনকে চেনেন?" সনাতন জিজ্ঞাসা করল।
"কি যে বলেন! আমি মইনুলকে চিনব না? ও আর আমি তো এমবিবিএস পর্যন্ত একসাথেই পড়াশোনা করেছি। ও এখন মেডিক্যাল কলেজে আছে তো।"
"হুমম্, আমার একটা ইনফরমেশন লাগবে। বছর চারেক আগে উনি কোনো এক ডাঃ এম আর চৌধুরিকে আইডি থেকে ঐ ভাইরাসটার চারটে স্যাম্পল কালেক্ট করার জন্য অথরাইজেন লেটার দিয়েছিলেন। কে সেই ডাক্তার? তার পরিচয় আমার লাগবে।"
"কোনো সমস্যা নেই, আমি এখুনি জেনে নিচ্ছি।"
ডাক্তার সামন্ত টেবিল থেকে মোবাইলটা নিয়ে তার বন্ধু ডাঃ মইনুল হোসেনকে ফোন করল। তাদের মধ্যে কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো তারপর ফোনটা রেখে বলল, "সনাতনবাবু ঐ এম আর চৌধুরি হলো মইনুলের ছাত্র মানস রায়চৌধুরি, এয়ারপোর্টের কাছে একটা আবাসনে থাকে। ওর ডিটেল এড্রেস আর ফোন নম্বর আমি আপনাকে মেসেজ করে দিচ্ছি।"
"অনেক ধন্যবাদ ডক্টর। আজ তাহলে উঠি" এই বলে সনাতন আর অভিরূপ সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ল।

ডাঃ সামন্তর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে সনাতন একটা সিগারেট ধরাল। সনাতনকে এখনো চিন্তা মুক্ত দেখাচ্ছে না। হটাৎ অভিকে সনাতন জিজ্ঞাসা করল, "অভি, তুমি যদি তোমার নাম শর্টে লেখো কি লিখবে?"
"কেন স্যার?" অভি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
"আহা! প্রশ্নের উপর প্রশ্ন কোরোনা। উত্তর দাও।" সনাতনকে একটু বিরক্ত হলো।
"স্যার আমি লিখব আইপিএস এ চ্যাটার্জি।"
"কেন? তোমার নাম তো অভিরূপ, তাহলে এ আর চ্যাটার্জি কেন নয়?"
"কি যে বলেন স্যার! চিন্তায় চিন্তায় আপনার মাথাটা গেছে।" এই বলে অভি হাসল
এবার সনাতন রেগে জিজ্ঞাসা করল, "কামঅন অভি, ডোন্ট বি ওভারস্মার্ট। যেটা জিজ্ঞাসা করেছি তার উত্তর দাও।"
"সরি স্যার। অভিরূপ তো একটাই কথা, এখানে অভি ফার্স্ট নেম আর রূপ মিডিল নেম তো নয় যে আমি এ আর লিখব।"
"একজ্যাক্টলি। তেমন রয়চৌধুরিও একটাই কথা তাহলে মানসবাবু ওনার নাম এম রয়চৌধুরি না লিখে এম আর চৌধুরি কেন লিখলেন?"
"এটা তো আমি ভেবে দেখিনি স্যার!" অভি অবাক হলো
"অভি, ভাবা প্র্যাক্টিস করো। আমি নিশ্চিত মানসবাবুকে দিয়েই গাঁট খোলা সুরু হবে।"
এমন সময় সনাতনের মোবাইলে ডিআইজির ফোন এলো। ডিআইজি তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সনাতন বলল কেস সলভ হওয়ার পথে, আগামী দু-এক দিনের ভিতরেই কালপ্রিট ধরা পরবে। ফোন রাখতেই সনাতনের মোবাইলটা আবার বেজে উঠল, ডাঃ সামন্ত মানসের ঠিকানা আর ফোন নম্বর পাঠিয়েছে। সনাতন মোবাইলটা অভির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, "মানসবাবুর নম্বরটা নোট করে নাও, আজ সন্ধ্যার মধ্যে আমার এই নম্বরের গত তিন বছরের কল হিস্ট্রি চাই।"

সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ অভি সনাতনের অফিসে এলো। কেবিনে ঢুকে অভি দেখল সনাতন চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে, ডান হাতটা টেবিলের উপর যার আঙুলের ফাঁকে একটা সিগারেট জ্বলছে আর বাম হাতের কব্জিটা কপালের উপর রাখা। সনাতন কিছু একটা বিড়বিড় করছিল।
"মে আই কামিন স্যার?" দরজায় টোকা মেরে অভি জিজ্ঞাসা করল।
"আরে এসো এসো" সনাতন জবাব দিল।
"স্যার, এই নিন মানসবাবুর কল হিস্ট্রি"
"ওটা তুমি কি দেখেছ? কোনো স্পেশাল নম্বর কি নোট করেছ?"
"হ্যাঁ স্যার করেছি। একটা নম্বর আছে যে নম্বরটা আমার কাছে সিগনিফিকেন্ট লেগেছে। কোনো কোনো দিন ঐ নম্বরের সাথে দশ বারো বার পর্যন্ত ফোনালাপ হয়েছে।"
"নম্বরটা কার সেটা কি খোঁজ নিয়েছ?"
"হ্যাঁ স্যার। তবে আলাদা করে খোঁজ নিতে হয় নি, আমার মোবাইলে নম্বরটা ডায়াল করতে নামটা স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে।"
"অর্থাৎ নম্বরটা তোমার ফোনে সেভ আছে! কার নম্বর? তাড়াতাড়ি বলো আমায়।"
"স্যার, নামটা আমি হজম করতে পারছি না। নম্বরটা অবনীর।"
"হোয়াট! আই সি....... খেলাটা এতক্ষণে আমার কাছে অনেকটা পরিষ্কার হলো। অভি তুমি চলে যাবার পর আমি ডাঃ মিহিরের বাড়ি গিয়েছিলাম। ওনার সাথে কথা বলে আমি এমন কিছু তথ্য পেয়েছি যা জানলে তোমার হুঁশ উড়ে যাবে।"
অভি টান টান হয়ে বসল, "কি তথ্য পেয়েছেন স্যার?"
"সময় হলেই জানতে পারবে। আপাতত বাড়ি যাও। কাল অনেক রাত হয়েছিল। প্রতিদিন এতো রাত করা ঠিক নয়।"
"ওকে স্যার। আমি উঠছি"
"ঠিক আছে। আর হ্যাঁ কাল সকালে দশটা নাগাদ এয়ারপোর্ট থানায় চলে যাবে। তার আগেই সেখানে মানসবাবুর নামের গ্রেফতারী পরোয়ানা পৌঁছে যাবে, ওনাকে তুলে নিয়ে সোজা এখানে চলে আসবে। থানায় কথা বলে আমি সব ব্যবস্থা করে রাখব।"
"ঠিক আছে স্যার। আজ তাহলে আমি যাই?"
সনাতন ইশারায় অভিকে চলে যেতে বলল।
"গুড নাইট" বলে অভি বেরিয়ে গেল।

সনাতনকে এখন অনেকটা রিল্যাক্সড লাগছে। মানসকে প্রায় চার ঘণ্টা জেরা করেছে তার পরেও মুখমণ্ডলে ক্লান্তির লেস মাত্র নেই। অনকে কষ্ট করে যখন কেউ কোনো দুর্গম গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে তখন তার মুখ থেকে ক্লান্তির ছাপ মুছে যায়। অভিকে সনাতন আজ রাত আটটায় সকলকে রায় বাড়িতে জড়ো করার নির্দেশ দিল। অভি বেরিয়ে গেলে সনাতন ফোন করল ডিআইজিকে-
"হ্যালো! বলো সনাতন।"
"গুড আফটারনুন স্যার"
"গুড আফটারনুন। কিছু সুসংবাদ দেবে মনে হচ্ছে?"
"নিশ্চয়ই স্যার। দ্যাট কেস হ্যাজ বিন সলভড্"
"ওয়েল ডান। তা কালপ্রিট কে? তাকে এরেস্ট করেছো,"
"না স্যার, এখনো করিনি। আজ রাত আটটায় সবার উপস্থিতিতে আমি এই রহস্য উদঘাটন করব আর আমি চাই সেখানে আপনিও উপস্থিত থাকুন।"
"নিশ্চয়ই থাকব। তোমার ডাকে কি আমি সারা না দিয়ে থাকতে পারি!"
"ঠিক আছে স্যার তাহলে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আমি আপনাকে পিক আপ করে নেব। রাখছি স্যার" এই বলে সনাতন ফোনটা কেটে দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল আর তার পর পরম তৃপ্তিতে সুখটান দিতে লাগল।

                                                                                          অঙ্কন ; তন্দ্রা ব্রহ্মচারী 

ঘড়ির কাঁটায় ঠিক আটটা বাজে। আরএন ভিলার বৈঠকখানায় একে একে বসে আছে শর্মিলা, অবনী, মিহির, রজনী আর রজনীর ছোটমামা। এর উল্টো দিকে বসে আছে ডিআইজি, সনাতন আর ডাঃ সামন্ত।
"সনাতন, অভি কোথায়? ডিআইজি জিজ্ঞাসা করল
"স্যার, অভি সময় মতো চলে আসবে।"
"তাহলে শুরু করো"
"ইয়েস স্যার" বলে সনাতন উঠে দাঁড়াল। "ইনি ডিআইজি সত্যসাধন মুখোপাধ্যায় আর আমি রাজ্য গোয়েন্দা দপ্তরের অফিসার সনাতন মিত্র", সনাতন পরিচয় দিল
"তবে সেদিন যে আপনি নিজেকে লোকাল থানার পুলিশ বলেছিলেন?" অবনী জিজ্ঞাসা করল
"সেদিন পরিচয় গোপন করার প্রয়োজন ছিল মিঃ সরকার" বলে সনাতন হাসল। "যে জন্য আপনাদের এখানে একত্রিত করেছি তা আপনাদের পরিবারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বছর তিনেক আগে এক অজানা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মিঃ রায়ের মৃত্যু হয় আর গত সপ্তাহে একইভাবে মৃত্যু হয় ওনার ছেলে রমেনের"
এই কথা বলতেই শর্মিলা গুঁমরে কেঁদে উঠল।
"শর্মিলাদেবি নিজেকে সামলান" ডিআইজি বলল
"হ্যাঁ, আমি যেটা বলছিলাম" সনাতন আবার শুরু করল, "আপনাদের যে কারণে আজ আমি এখানে একত্রিত করেছি, রথীনবাবু এবং রমেন দুজনেরই মৃত্যু স্বাভাবিক নয়, ওঁদের দুজনকেই খুন করা হয়েছে।"
ঘরের মধ্যে হটাৎই কয়েক মিনিটের স্তব্ধটা আর তারপরেই ছোটো মামা চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল, "কি বলছেন ইন্সপেক্টর? কিন্তু ওদের তো জ্বরে মৃত্যু হয়েছিল!"
"হ্যাঁ একেবারেই তাই", সনাতন মামাকে জবাব দিতে লাগল, "বায়োলজিকাল ওয়েপন, জৈবিক অস্ত্র, শুনেছেন?"
"মানে, হেঁয়ালি না করে পরিস্কার করে বলুন" মামাকে রীতিমতো অস্থির দেখাচ্ছে
"আজ থেকে বছর সাতাশ আঠাশ আগে বিশ্বব্যাপী অতিমারি সৃষ্টি করেছিল একটা ভাইরাস, মনে আছে?"
"হ্যাঁ, খুব মনে আছে" মামা জবাব দিল
"ঐ ভাইরাসের প্রয়োগেই দুজনের মৃত্যু হয়"
এতক্ষণ রজনী চুপ ছিল, এবার মুখ খুলল, "কিন্তু কে, কেনই বা দাদা আর রমেন কে খুন করবে?"
"খুনের কারন বলতে পারেন সম্পত্তির লোভ, সম্পর্কের টানাপোড়েন ও প্রতিহিংসা আর খুনি হলেন........." চারিদিকে স্তব্ধতা, কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সনাতন অবনীর দিকে আঙুল তুলে দেখাল
"হাও ডিয়ার ইউ মিস্টার মিত্র! কি যাতা বলছেন?" অবনী চিৎকার করে উঠল
"শান্ত হন অবনীবাবু। দেখুন তো ওনাকে চিনতে পারেন কি না" এই বলে সনাতন অভিকে ডাকল, "অভি ওনাকে নিয়ে ভিতরে এসো"
সঙ্গে সঙ্গে অভি একজনকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল যার হাত দুটো পিছন দিক থেকে হাতকড়া দিয়ে বাঁধা ছিল। তাকে দেখেই অবনী চমকে উঠল, "মানস তুই! সব বলে দিয়েছিস?"
"অবনীদা তুমি আমাদের এতো বড় ক্ষতি করলে? তোমার দাদা এতো কিছু করল, তোমাকে ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করালো আর সেই তুমি কিনা........." রজনী কাঁদতে কাঁদতে বলল
"চুপ কর, নাটক করিস না, তোর দাদা এগুলো আমার জন্য করে নি, নিজের জন্য করেছে যাতে আমি ওর ব্যাবসা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলতে পারি আর আমি করছিলামও কিন্তু তোর দাদা কি করল? সমস্থ সম্পত্তি রমেনের নামে লিখে দিল! মানে আমি চিরকাল চাকরই থেকে যাবো, প্রথমে রথীন্দ্রনাথ রায়ের আর তারপর রমেন্দ্র নাথ রায়ের। সেই জন্যই আমি এদের সরিয়ে দিয়েছি।"
"কি শর্মিলাদেবি কিছু বলবেন না?" সনাতন মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করল
"হ্যাঁ-হ্যাঁ নিশ্চয়ই বলব" শর্মিলা উত্তর দিল তারপর অবনীর দিকে তাকিয়ে বলল "এটা তুমি কি করলে অবনী!"
অবনী চট করে শর্মিলার দিকে তাকাল আর তার দিকে কটকট করে তাকিয়ে রইল
সনাতন আবার মুচকি হাসল তারপর বলল "গল্পে টুইস্ট এখনো আছে। এই চক্রান্তের মূলে আরও একজন আছেন"
"আবার কে আছে এর পিছনে?" মিহির জিজ্ঞাসা করল
"মিসেস রায়" সনাতন উচ্চস্বরে বলল
"মিথ্যা কথা, এসব চক্রান্ত" চেঁচিয়ে উঠল শর্মিলা
ঘরে উপস্থিত প্রত্যেকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, ডাঃ সামন্ত আশ্চর্যের সাথে চেঁচিয়ে উঠলেন "হোয়াট!" ডিআইজির অবাক হয়ে বলল, "কি বলছ সনাতন! উনি কেন ওনার ছেলেকে মারবেন?"
"শর্মিলাদেবি রমেনের নিজের মা নন, সৎ মা আর রমেনের একমাত্র মাসি। রমেনের জন্মের সাথে সাথেই ওর মা মারা যান। এরপর পারিবারিক চাপে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শর্মিলাদেবি বাধ্য হন রথীনবাবুকে বিয়ে করতে। কি শর্মিলাদেবি এবার আপনি বলবেন না আমিই বলব?"
শর্মিলা মাথা নিচু করে বিষধর সাপের মতো ফুঁসছে, সনাতনের প্রশ্নে কোনো জবাব দিল না
"তাহলে আমিই বলি" সনাতন বলতে শুরু করল, "রথীনবাবুর উইল অনুযায়ী আঠারো পেরোলে সব সম্পত্তি রমেনের হওয়ার কথা। একথা অবনীবাবু জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হন সে কথা উনি আগেই বলেছেন। এদিকে শর্মিলাদেবির দিদি প্রসবকালীন মৃত্যুর পর পরিবারের চাপে উনি বাধ্য হন রথীনবাবুকে বিয়ে করতে, এরপর রথীনবাবুর মাথায় একটা ভয় ঢোকে যদি শর্মিলাদেবির নিজের সন্তান হলে উনি রমেনের অবহেলা করেন তাই শর্মিলাদেবিকে একরকম বাধ্য করেন নিঃসন্তান থাকতে, উনি একবার অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পরলে রথীনবাবু ওষুধ দিয়ে সেই বাচ্ছা নষ্ট করে দেন। ফলে শর্মিলাদেবির ভিতরে জ্বলে ওঠে প্রতিহিংসার আগুন। ইতিমধ্যেই শর্মিলাদেবি অবনীবাবুর ক্ষোভের কথা জানতে পেরে দুজন হাত মেলান। এরপর থেকে চলতে থাকে খুনের পরিকল্পনা। আলোচনা চলতে থাকে কিভাবে দুজনকে খুন করা হবে যাতে কেউ জানতে না পারে আর এটাকে স্বাভাবিক মৃত্যুর রূপ দেওয়া যায় তা নিয়ে। এমনই একসময় শর্মিলাদেবির মনে পরে অবনীবাবু লন্ডন থেকে ফিরে একবার কথা প্রসঙ্গে ওনার বন্ধু ভাইরোলজিস্ট মানসবাবুর ও তার কাছ থেকে শোনা এই ভাইরাসের গল্প বলেছিলেন এবং এও বলেছিলেন যে তিনি অর্থাভাবে এই ভাইরাসের উপর রিসার্চ করতে পারছেন না। ব্যাস শর্মিলাদেবির মাথায় পুরো ছক খেলে যায়। মানসবাবু চলে যান কোচিন। শর্মিলাদেবির পরামর্শ মতোই উনি ওখানে নিজের নামের সংক্ষিপ্তাকার লেখেন ডক্টর এম আর চৌধুরি যেটা মিহিরবাবুর নামের সংক্ষিপ্তাকার।"
মিহির জিজ্ঞাসা করল, "কিন্তু এই ভাইরাসটা তো খুব ছোঁয়াচ, এর থেকে বাড়ির প্রত্যেকের ইনফেক্টেড হওয়ার কথা!"
ডক্টর সামন্ত মিহিরবাবুকে থামিয়ে দিয়ে বলল, "ডক্টর যে ভাইরাসটা ওদের শরীরে ইনজেক্ট করা হয়েছিল তার উপর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়োগ করে এর প্রটিন এনভেলপটা দুর্বল করে দেওয়া হয় যার ফলে এর ক্ষমতা ব্যাপক হ্রাস পায়। এর অন্য শরীরে ছড়িয়ে পরার কোনো ক্ষমতাই ছিল না, আই এই অসাধ্য সাধন করেছে মানস। কিন্তু দুঃখের বিষয় ও তার এই জ্ঞানটা কোনো ভালো কাজে লাগল না।"
মিহির আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল,"তাহলে তো ডক্টর সামন্ত ভাইরাসটার প্রাণ নেওয়ারও ক্ষমতা ছিল না?"
"এখানেও মানসের শয়তানী বুদ্ধি কাজ করেছে। আপনি তো নিশ্চয়ই জানেন যে বেশ কিছু এন্টি ফাঙ্গাল ওষুধ আছে যেগুলো আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সেইসব ওষুধ শর্মিলাদেবি ওদের খাওয়াতেন। এর ফলে ওদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভিষন কমে যায় আর সেই সুযোগে এই ভাইরাস ওদের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে" সনাতন জবাব দিল।
"এতো হিংস্র মানুষ হতে পারে" ডাক্তার সামন্ত বিড়বিড় করল
"অভি অবনীবাবু আর শর্মিলাদেবিরকে নিয়ে যাও" সনাতন বলল। সঙ্গে সঙ্গে একদল পুরুষ ও মহিলা পুলিশ এসে ওদের নিয়ে চলে গেল।
ডিআইজি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তারপর সনাতনের কাছে এগিয়ে গিয়ে সনাতনের কাঁধ চাপড়াতে চাপড়াতে বলল, "ব্রাভ মাই সান, আমি জানতাম তুমিই একমাত্র পারবে। আই স্যালুট ইউ।
"স্যার আপনি যে আমার উপর বিশ্বাস রেখেছেন তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই" সনাতন বলল ডিআইজিকে  তারপর মিহিরের দিকে তাকিয়ে বলল, "মিহিরবাবুর আমি আপনাকে অনেক কটু কথা বলেছি, তার জন্য আবার ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।"
"ছিঃ ছিঃ ইনসপেক্টর, আপনি সেদিনও আমার বাড়িতে এসে একই কথা বললেন, আজও একই কথা বলছেন। এইভাবে আমাকে আর লজ্জিত করবেন না। আপনি তো শুধু মাত্র আপনার কর্তব্য পালন করেছেন।"
অভিকে বলল, "মিহির বাবু আপনার আর রজনীদেবির বিয়েতে কিন্তু আমাদের নেমন্তন্ন করতে ভুলবেন না, একেবারে কব্জি ডুবিয়ে খাব।"
"হা-হা-হা-হা-হা-হা-হা......" ঘরে উপস্থিত সকলে হাসিতে ফেটে পড়ল।

সোমবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২০

স্বপ্ন

স্বপ্ন
       উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী

                                                               আঙ্কন ; তন্দ্রা ব্রহ্মচারী

উৎসবের জঙ্গলে চলছে হরেক খেলা,
সব পশুরা একত্রিত, বসেছে বিরাট মেলা,
হচ্ছে ক্রিকেট, ফুটবল আর হকি।
কি আশ্চর্য! এসব হচ্ছেটা কি?
হাতি বনাম শেয়াল হচ্ছে ক্রিকেট ম্যাচ,
শেয়ালর বলে হাতি মশাই মেরেই হলেন ক্যাচ।
বাঘমামা ঐ ফুটবলটা মারলেন তাঁর হেডে-
বলটা সটান চলে গেল উটবেড়ালের নেটে।
হরিণমশায় হকি স্টিকটা চালালেন গায়ের জোরে,
সিংহ রেফারি বাঁশি বাজাতেই ভল্লুকরা গেল হেরে।
পটকা, বাজি, রংমশালে আকাশ গেল রেঙে,
হটাৎ মায়ের জলের ছিটায় ঘুমটা গেল ভেঙে।

পনেরোই আগস্ট

পনেরোই আগস্ট
               উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী

আজ পনেরোই আগস্ট, আজ স্বাধীনতা দিবস।
সে বলল, সেটা আবার কি!
বললাম, জানিস না? ঊনিশ‌শ সাতচল্লিশ সালে
আজকের দিনেই তো-
অত্যাচারী বৃটিশদের থেকে আমরা
পেয়েছিলাম মুক্তি- স্বাধীনতা।
সে বলল, স্বা-ধী-ন-তা! হা হা হা-
বললাম, হাসছিস যে?
সে বলল, স্বাধীনতা না ছাই!
একে বলে প্রভু বদল,
ছিল বিদেশী প্রভু, হলো দেশী।
বললাম, কি বলছিস যাতা?
সে বলল, কাকে বলে স্বাধীনতা?
বললাম, দেখছিস না আজ-
দিকে দিকে তিরঙ্গা, দিকে দিকে
বন্দেমাতরম আওয়াজ?
কান পেতে শোন, ভেসে আসছে
কতো স্বদেশী গান, কবিতা।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে বলল, বুঝলাম-
এটাই হলো তোর স্বাধীনতা!
বললাম, স্বাধীনতা মানে তো তাই!
সে বলল, চল তবে তোকে শোনাই--
যদি করো সরকারের সমালোচনা-
পাবে তুমি দেশদ্রোহী তকমা!
যে হবেনা সরকারের সঙ্গী,
রাতারাতি সে হয়ে যাবে জঙ্গী।
মুক্ত চিন্তার মানুষ হলে, ঠিকানা হবে-
তিহার জেলে।
নেতাদের, মন্ত্রীদের বিদেশী ব্যাঙ্কের
খাতা কালো টাকায় উপচে পরে,
তারাই আবার পতাকা তোলে,
দেশভক্তির বুলি ঝাড়ে।
পেটের জ্বালায় ট্রাফিক সিগন্যালে
যে বৃদ্ধ একটুকরো কাপড় হাতে
বাধ্য হয় বাবুদের গাড়ির-
কাঁচ পরিষ্কার করতে,
তার কাছে স্বাধীনতার মানে কি?
যে শিক্ষিত যুবক রিক্সা চালায়, করে হকারি-
তার কাছে স্বাধীনতার মানে কি?
ঋণের দায়ে যে কৃষক
আত্মহত্যার পথ বাছে,
তার কাছে কি এই স্বাধীনতার-
কোনো অর্থ আছে?
অভাবে, দারিদ্রে যে শিশুপেল না
শিক্ষার আলো
এই স্বাধীনতা তাকে কি দিলো?
বললাম, তবে স্বাধীনতা মানে কি?
সে বলল, স্বাধীনতা হলো-
খাদ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার,
বেকারত্ব, দুর্নীতি থেকে মুক্তি,
প্রতিটা নাগরিকের বলার অধিকার,
প্রত্যেকের চিকিৎসা পাবার অধিকার।
অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলাম-
বললাম, ঠিকই তো, এটাই তো-
আসল স্বাধীনতা!
তুই কে? কি তোর ঠিকানা?
সে বলল, নিজের মধ্যে খুঁজে নে,
আমি তোর থেকে পৃথক কেউ না।

করোনা কাহন

করোনা কাহন
               উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী

বিশ্ব জোড়া আজ অন্ধকার, কালো মেঘে ঢাকা,
দোকান-বাজার জনশূণ্য, রাস্তা-ঘাট ফাঁকা।
বিশ্বযুদ্ধের আগমনে মনুষ্যকূল ভিত-সন্ত্রস্ত,
শত্রু যে অণুবীক্ষণিক, ছোঁয়াচে; ভয় তাই মস্ত।

চীন দেশের এক শহর, নাম টি তার উহান,
জিয়াং নামের এক ডাক্তার, ছিলেন বড়ই মহান।
সর্দি কাশির রোগীর দেহে পেলেন নতুন ভাইরাস,
পরীক্ষা করে দেখলেন তিনি এটি অতি সিরিয়াস।

করোনা নামের এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ল হু-হু,
সংক্রমিত লক্ষাধিক, বিশ্ব জোড়া প্রাণ নিয়েছে বহু।
ওষুধ নেই চিকিৎসা নেই কিন্তু নেইকো কোনো ভয়,
সাবধানতা, সচেতনতা এই অস্ত্রে পাবই মোরা জয়।

হাওয়ায় পারে না উড়তে সে, ছড়ায় শুধুই ছোঁয়ায়,
যত্রতত্র থুতু নয়, আটকাবে ঘনঘন সাবানে হাত ধোয়ায়।
দোকান-বাজার-রাস্তা-ঘাটে রাখুন দুরত্ব এক মিটার,
মহামারী থেকে বাঁচতে আপনার সহযোগিতা দরকার।

সর্দি-কাশি-জ্বর হলেই নেবেন চিকিৎসকের শলা,
উপসর্গ অতি সামান্য হলেও করবেন না অবহেলা।
সরকার-প্রশাসনের নির্দেশ মেনে ঘরে থাকুন বন্দী
অপ্রয়োজনে বাইরে বেরোনোর আঁটবেন না ফন্দি।

ছুড়ে ফেল কুসংস্কার, ছড়িও নাকো গুজব,
না তো এটা অবতার, না আল্লাহ্-র গজব।
মেঘ কাটবে, আলো আসবে করোনা হবে দূর,
জয় মোদের হবেই হবে মনে বিশ্বাস রেখো ভরপুর।

রাজাকার সাবধান


রাজাকার সাবধান
                     উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী

বাঙালী ঝরিয়েছে অনেক রক্ত, দিয়েছে সহস্র প্রাণ,
আজও তার প্রমান দিচ্ছে শাহবাগের পবিত্র স্থান ।
বাঙালী ভেঙ্গেছে ব্রিটিশ দম্ভ, করেছে জয় পাকিস্থান,
তাইতো বলি রাজাকারের দল তোরা সব সাবধান ।

বাংলা গড়তে শহিদ হয়েছেন বঙ্গবন্ধু মুজিব,
বাংলা বাঁচাতে শহিদ হলেন হায়দার রাজীব ।
জানি তোমাদের পবিত্র প্রাণ যাবেনা নিস্ফল,
বাংলায় তোমরা পুজীত হবে শহর হতে মফঃসল ।

রাজাকারদের একটাই শাস্তি, চাই ফাঁসি সত্ত্বর,
এই দাবিতেই অবিচল আজ প্রজন্ম চত্ত্বর ।
বন্ধ কর ধর্ম-ব্যাবসা, বন্ধ কর ঘৃণা,
তোমাদের ঐ চোখ রাঙানি আমরা আর সইব না ।

এপার বাংলা–ওপার বাংলা, বাংলা মোদের প্রাণ,
নেইকো হেথায় কোন ভেদাভেদ হিন্দু-মুসলমান
গড়ব মোরা নতুন বাংলা লড়িয়ে দিয়ে জান,
তাইতো বলি রাজাকারের দল তোরা সব সাবধান ।

সৈনিক

সৈনিক           উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী   ছেলেটা গত কালই বাড়ি ফিরেছিল, ছ'মাস পর, মাঝে ছুটি পায়নি সে। ফুলসজ্জার পরের দিন চলে যেতে হয়েছ...