মরীচিকা
উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী
সকাল থেকে কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল তবুও ভ্যাপসা গরমটা গেল না। বেলা এগারোটা বেজে গেছে, এখনো সূর্যের আলোর দেখা নেই। ভ্যাপসা গরমের জন্য রাস্তা ঘাট প্রায় জনশূন্য। ব্যতিক্রম শুধু সিধুদার চায়ের দোকান। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা বেকার যুবকদের কাছে সিধুদাই ভরসা। সিধুদা সবার দাদা। বাবারও দাদা ছেলেরও দাদা। বয়স আনুমানিক বছর ষাটেক হবে। কিন্তু সবাই সিধুদাকে দাদা বলেই ডাকে। জনশূন্য রাস্তার মোড়ের এই চায়ের দোকানে এই মুহূর্তে পাঁচজন চা-সিগারেট সহযোগে আড্ডা দিচ্ছে। পল্লব, অনিন্দ্য, আশফাক, সৌম্য আর নিশীথ। এরা পাঁচ জন ছোটবেলার বন্ধু। সেই প্রাইমারি স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত এক সাথে পড়েছে। স্বভাবতই তাদের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। গত সপ্তাহেই ওদের গ্র্যাজুয়েশনের ফাইনাল সেমিস্টার শেষ হয়েছে। এখন অপেক্ষা রেজাল্টের। এই রেজাল্টই ঠিক করে দেবে পরবর্তী কালে ওরা আর একসাথে থাকবে কি না বা কে কার সাথে থাকবে। পাড়ার মোড়ে সিধুদার চায়ের দোকানের চা বেকার যুবককূলের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এতো চায়ের দোকান নয়, যেন প্রাইভেট টিউশন। এক একটা ক্লাসের এক একটা ব্যাচ যায় আবার একটা নতুন ব্যাচ ঢোকে। তবে সিধুদা কিন্তু সবার বন্ধু। সৌম্যদের সেমিস্টার শেষ হওয়ার পরের দিন ওরা পাঁচ জন যখন সিধুদার দোকানে চা খেতে এলো সিধুদা বলেছিল, "এই আরও একদল বেকার তৈরী হলো। এই যে নতুন বেকারের দল আমার চায়ের দোকানে তোদের স্বগত"
"মানে? আমরা কি তোমার দোকানে এই প্রথম এলাম নাকি!" আশফাক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
বড় আধপোড়া সসপ্যানের গায়ে লেগে থাকা দুধের সর চামচ দিয়ে চাঁচতে চাঁচতে সিধুদা মুচকি হেসে বলল "ওরে কাল পর্যন্ত তোরা ছিলি ছাত্র। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট, মানে আজ থেকে তোরা অফিসিয়ালি বেকার যুবক হলি। মাথায় ঢুকল?"
সিধুদার কথায় ওদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল। কিন্তু কথাটা কেউ ফেলে দিতে পারল না। চায়ে কাপে চুমুক দিয়ে শুরু হল তাদের আড্ডা। পাড়া-ঘর, দেশ-বিদেশ, খেলা, রাজনীতি, সিনেমা - আড্ডার বিষয়বস্তুর যেন কোনো সীমা নেই। অনিন্দ্য বলল, "আমরা এতো কিছু নিয়ে আলোচনা করছি যখন তখন একটা নিজেদের ভবিষ্যত নিয়েও আলোচনা হোক। নাকি ওটা বাদের খাতায়?"
"কিরে সৌম্য, তুই কিছু ভাবলি?" পল্লব জিজ্ঞাসা করল
সৌম্য এক চুমুকে চায়ের কাপের তলানিটা শেষ করে একটা সিগারেট ধরাল, তারপর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, "নাহ্! সেভাবে কিছু এখনো ঠিক করি নি। তবে আমার ইচ্ছা আছে মাসকমিউনিকেশনে মাস্টার্স করার সে তো তোরা জানিসই। তবে সব কিছু নির্ভর করছে রেজাল্টের উপর"
নিশীথ মুচকি হেসে বলল, "মানে তোর মাথা থেকে ইনভেস্টিগেটিভ জার্নলিস্ট হওয়ার ভুতটা এখনো নামে নি?"
"না রে শুধু ইনভেস্টিগেটিভ জার্নলিসম নয় ইদানীং আমার আরও একটা বিষয়ে আমার ইন্টারেস্ট জেগেছে। ফরেন রিলেশনশিপ অর্থাৎ বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক সাংবাদিকতা। যাই হোক, এবার তোদের ব্যাপারে বল।"
নিশীথ বলল, "আমার বাবার আর আমাকে পড়ানোর ক্ষমতা নেই। সুতরাং আমার এখানেই দ্যা এন্ড। দেখি কোথাও একটা কাজ-টাজ জোগাড় করতে পারি কিনা।"
পল্লব বলল যে তার এসব নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। রেজাল্টের পর এসব নিয়ে ভাববে। টেনশন করে এই মূল্যবান অবকাশটা সে নষ্ট করতে চায় না।
"আর পরিচালক মশাই আপনি কি সিনেমা পরিচালনা করবেন?" অনিন্দ্য আশফাককে জিজ্ঞাসা করল
"পরিচালক আশফাকের কাছে আমার একটাই রিকোয়েস্ট আমাকে পাওলি দামের সাথে একবার দেখা করিয়ে দিস। হোয়াট অ্যা সিডাক্টিভ লুক! যেন আমার বুকের ভেতরটা খান খান হয়ে যায়। ভাই দেখা করিয়ে দিবি তো একবার?" সৌম্য চটুল ভঙ্গিমায় আশফাকের কাছে তার অনুরোধ রাখল।
বিরক্তির সুরে আশফাক বলল, "ধুর শালা! ছাড় তো ওসব কথা। আব্বা আমাকে আব্বার ব্যবসায় ঢুকতে বলছে। ওসব পরিচালক হওয়ার ভুত নাকি ঘাড় থেকে নামাতে হবে।"
"কি বললি? আমাদের স্কুল-কলেজে নাটক থিয়েটার পরিচালনা করে প্রশংসা কুড়নো ছেলেটা যার চোখে টলিউডের পরিচালক হওয়ার স্বপ্ন সে কিনা সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে বাপের জুতোর দোকানের কাউন্টারে বসবে! কি যাতা বলছিস এসব?" সৌম্য তেড়েফুঁড়ে উঠল
"আব্বাকে মৌলবী সাহেব বুঝিয়েছে এসব নাকি হারাম। তাই এসব ভুত মাথা থেকে নামিয়ে আমাকে ব্যবসায় ঢোকাতে বলেছে। তোরা চিন্তা কর যে লোকটা নিজে ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে লোক ঠকিয়ে নিজের পেট চালায় সেই লোকটা নাকি আমার কেরিয়ারের দিক নির্দেশনা করছে! রিডিকুলাস!"
"সৌম্য, ঐ দেখ তোর বাগচি দাদু আসছে। এদিকেই আসছে মনে হচ্ছে" অনিন্দ্য এক বৃদ্ধের দিকে ইঙ্গিত করে বলল
সকলে তাকিয়ে দেখল এক বৃদ্ধ তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। বয়স হবে প্রায় পঁচাত্তর বছর, শরীর এখনো বেশ শক্ত। তবে চোখের নিচে ঝুলে পরা চামড়ায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। গটগট করে হেঁটে তাদের দিকেই আসছে।
সবাই তাড়াতাড়ি করে তাদের হাতের জ্বলন্ত সিগারেটগুলো লুকিয়ে নিল। সৌম্য একটু উচ্চ স্বরে বলল, "ও বাগচি দাদু, রাস্তা ভুল হলো নাকি? আজ এ দিকে কি ব্যাপার?" বাগচিদাদু দূর থেকে ফিরে গেলে আর বাবার পকেট কেটে কেনা সিগারেটটা আধখাওয়া অবস্থা ফেলে দিতে হয় না।
উদ্দেশ্য সফল হলো। দূর থেকেই বৃদ্ধ জানাল যে সৌম্যকে খুঁজতেই আসছিল, সৌম্য যেন সন্ধ্যা বেলায় একবার দেখা করে।
পাঁচজনই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সকলেই তাদের সিগারেট বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য সৌম্যকে ধন্যবাদ জানাল।
"এই বুড়ো কারোর সাথে মেশে না, কাউকে সেভাবে কোনো কথা বলে না কিন্তু তোকে কেন এতো ভালোবাসে বলতো?" পল্লব সৌম্যকে জিজ্ঞাসা করল
"জানি না রে। তবে সেই যে ছোটো বেলায় আমি দাদুর সাইকেলে ধাক্কা খেয়ে পরে গেলাম, আমার মাথা ফেটে গেল তারপর থেকেই দাদু আমাকে খুব ভালোবাসেন। তোদেরকে তো কতবার বলেছি আমার সাথে দাদুর কাছে চ, দেখবি উনি একদম অন্য মানুষ যেমন বাইরে দেখান তেমন মানুষ উনি নন। জানিস ওনার ভিতরে না একটা কোন বড় দুঃখ আছে, কিছু একটা না পাওয়ার দুঃখ আর তার জন্যই উনি নিজেকে গুটিয়ে রাখেন।" সৌম্য প্রায় এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল।
শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটের ফিল্টারটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে আগুন নেভাতে নেভাতে নিশীথ বলল, "মাথা খারাপ! এমনিতেই আমার মা বলে বাঙালরা খুব ফেরোসাস হয় তার উপর এই বুড়োকে দেখলেই কেমন যেন খুনি-খুনি মনে হয়।"
সৌম্যকে দৃশ্যতই বিরক্ত লাগছিল, "নিশীথ দাদুর বয়সী মানুষটাকে একটু সম্মান দিয়ে কথা বল প্লিজ। তখন থেকে বুড়ো-বুড়ো বলে যাচ্ছিস। এটা কি ঠিক?"
"সরি, সৌম্য আমি ঠিক সেভাবে বলতে চাইনি"
"আর একটা কথা বলি নিশীথ, রাতারাতি যে মানুষগুলোর মাথার উপর থেকে ছাদ চলে যায়, কোনওক্রমে জীবন বাঁচিয়ে নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পালিয়ে যেতে হয় আর তারপর সেই দেশে গিয়েও প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে হয় তারা খুব স্বাভাবিকভাবেই একটু ডেসপ্যারেট তো হবেই আর তাদের সেই ডেসপ্যারেটনেশটাকে তোর-আমার মতো তুলনায় সুখী মানুষরা ফেরোসাসনেশ বলে জাজ করি", খুব গম্ভীর হয়ে সৌম্য কথাগুলো বলল। একটা লম্বা টান দিয়ে সিগারেটটা ফেলে দিল সৌম্য, তারপর আবার বলতে শুরু করল, "দেখ কিছু মানুষ আছে যারা মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ভাবে বিভেদ সৃষ্টি করে নিজেদের লাভের জন্য। ধর্মীয় বিভেদ, জাতিগত বিভেদ, ভাষাগত তথা আঞ্চলিকতা বিভেদ, শরীরের রং নিয়ে বিভেদ- যে কোনো বিভেদেই কারোর না কারোর লাভ হয় কিন্তু মানব জাতি তথা এই সৃষ্টির ক্ষতি হয়।
"কি বলছিস! ধর্ম তো ভগবানের সৃষ্টি" অনিন্দ্য সৌম্যর কথায় প্রতিবাদ জানাল।
"আচ্ছা! ঠিক আছে। তাহলে আমাকে বল তো মানুষ, গরু, ছাগল, বাঘ, সাপ, ব্যাঙ, হাতি, পোকা-মাকড় এতো কিছু সব তোর ঐ ভগবানই বানিছে তো?"
"অবশ্যই" দৃঢ় কন্ঠে অনিন্দ্য উত্তর দিল
"আচ্ছা এরা প্রত্যেকেই দেখতে কমপ্লিটলি আলাদা?"
"হ্যাঁ, একদমই তাই"
"তাহলে তোর কথা অনুযায়ী ধর্ম যদি ভগবানের সৃষ্টি হয় তাহলে আলাদা আলাদা ধর্মের মানুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য আলাদা হওয়া উচিৎ ছিল? তা কেন নয়?"
"এটা তো ভেবে দেখিনি! ভ্যালিড কোয়েশ্চেন।"
"ভাব, ভাব, ভাবতে শেখ। দেখ ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছে আর মানুষ ধর্ম নামের বিষাক্ত প্রাচীর দিয়ে নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। আমার মতে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করাই হল ঈশ্বরের সবচেয়ে বড় অবমাননা।"
"একদম ঠিক বলেছিস সৌম্য, এভাবে আমরা সত্যিই কখনো ভেবে দেখিনি" পল্লব কৃতজ্ঞতার সুরে বলল।
"বন্ধুগন, বেলা একটা বাজে। মা এবার ঝাঁটা নিয়ে আসবে। চল আজকের মতো উঠি" সৌম্য উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পিছন ঝাড়তে ঝাড়তে বলল।
সকলে সম্মতি জানিয়ে উঠে পরল।
দরজায় বার দুয়েক টোকা দিয়ে প্রায় মিনিট পাঁচেক ধরে অপেক্ষা করছে সৌম্য। এখনো ভিতর থেকে কোনো সারা আসছে না। অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে ডাকল "দাদু, ও দাদু! এখনো ঘুমোচ্ছ নাকি?" এবার ভিতর থেকে সারা এলো। আরও মিনিট খানেক অপেক্ষার পর দরজা খুলল। ভিতর থেকে সেই বৃদ্ধ লোকটি বেরিয়ে এলো। মাথার চুলগুলো সব পেকে গেলেও দাঁত একটাও পরে নি। বৃদ্ধের নাম দীপঙ্কর বাগচি।
"আয় আয়। বোস ওখানে" সোফার দিকে ইশারা করে সৌম্য কে বসতে বলল দীপঙ্কর।
ঘরটা বেশ পরিপাটি করে গোছানো। ঘরে ঢুকে বাঁ দিকের এক কোণে টেবিলের উপর একটা পিকচারটিউব দেওয়া টিভি, তার পাশে একটা বছর চোদ্দ-পনেরোর মেয়ের সাদা-কালো ছবি ফ্রেম করে টাঙানো। টিভির ঠিক উল্টো প্রান্তে সোফা আর তার সামনে একটা কাঁচের টি-টেবিল রাখা। অবিবাহিত দীপঙ্কর বাগচি একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি চাকরি করত। মা-ববাকে নিয়ে তার সংসার ছিল। প্রায় বছর কুড়ি আগে বাবা আর মা দুজনেই মারা গেছে। তাই এখন সে একাই। একটা ওয়ান-বি-এইচ-কে ফ্লাটই তার দুনিয়া। আত্মীয় স্বজন বলতে তার কেউ নেই। কাছের কেউ বলতে একমাত্র পাড়ার ছেলে সৌম্য। এছাড়া সে আর কারোর সাথে সে ভাবে মেশে না। কথাও প্রায় বলে না বললেই চলে। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে যতটা সম্ভব ইশারায় জবাব দেয়। যেন কথা বলতে না হলেই ভালো।
সৌম্য সোফায় বসেতেই দীপঙ্কর রান্নাঘরের ভিতর চলে গেল। মিনিট খানেক পর একটা কাঁচের প্লেটে কয়েক রকমের মিষ্টি আর সিঙাড়া নিয়ে বেরিয়ে এলো।
সৌম্য অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, "দাদু এসব কি? এতো কার জন্য?"
"এখানে তুই ছাড়া আর কে আছে?"
"তুমি পাগল এতো খাওয়া যায় নাকি?"
"খুব খাওয়া যায়। এই বয়সে খাবি না তো কোন বয়সে খাবি! আর তাছাড়া এই সিঙাড়া কিন্তু আমার নিজের বানানো। দোকানের পচা তেলে ভাজা নয়।"
"ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করছি। কিন্তু দাদু এসব কোন খুশিতে?"
"কেন? তোকে কি এমনি কখনো খাওয়াই নি আমি?"
রসগোল্লা চিবোতে চিবোতে সৌম্য বলল, "তা বলছি না তবে আজ তোমাকে একটু অন্যরকম লাগছে। নিশ্চয়ই কোনো ব্যাপার আছে।"
"তা আছে। আজ আমি ভীষণ খুশি। অনেক দিন পর আজ আমার এতো ভালো লাগছে" আবেগে দীপঙ্করের গলা যেন বুজে আসছে
"কি হয়েছে বলো না দাদু।"
"আগে তুই সব খা তারপর বলব।"
"না, না। তুমি বলো আমি খেতে খেতেই শুনছি।"
"তবে শোন। তুই বারবার আমাকে জিজ্ঞাসা করিস না দেওয়ালে টাঙানো ঐ ছবিটা কার?
"হ্যাঁ। কার ছবি ওটা?"
"ওর নাম মীরা। মীরা দেবনাথ। পুরো ঘটনা জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে আজ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে।"
সালটা ১৯৭০। সারা বাংলা দেশ তখন যেন বারুদের স্তূপ। এতোটুকু স্ফুলিঙ্গ পেলেই যেকোনো সময় ঘটে যাবে বিরাট বিস্ফোড়ন। বাংলাদেশের আবার-বৃদ্ধ-বনিতা তখন পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর অত্যাচারের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর স্বপ্ন বিভোর।স্বাধীনতার আশায় সবাই টগবগ করে ফুটছে। তবে আলাদা বাংলাদেশের দাবি ততটা জোড়ালো হয় নি।
আমার বাড়ি ছিল রংপুরের উত্তরে এক গ্রামে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, এমএ-র ফাইল ইয়ার। আমি থাকতাম ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ আবাসনে। ঐ আবাসনের কাছেই ছিল মীরার বাড়ি। আমার বয়স কতো আর হবে, এই ধর বছর পঁচিশ আর মীরার বয়স তখন কুড়ি কি একুশ। যদিও মীরার সাথে পরিচয় আমার অনেক আগে থেকেই ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে একটা চায়ের দোকান ছিল, শফিক মিয়ার চায়ের দোকান। সেখানে আমরা চা খেতাম আর সেই চায়ের দোকানের ঠিক লাগোয়া একটা ঘরে মীরার দাদা বিনা পয়সায় গরীব ছেলে মেয়েদের পড়াতো যেখানে সে নিজেও পড়তে আসত। দিনের একটা সময় আমরা ওখানে আড্ডা দিতাম, ঠিক যেমন তোরা ঐ সিধুর দোকানে আড্ডা দিস। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় বস্তু ছিল মূলত রাজনৈতিক। আমরা প্রায় প্রত্যেকেই বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ষড়যন্ত্র, পাকিস্তান আর্মির অত্যাচার, পাকিস্তান পিপলস পার্টি ও তার প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর রণনীতি- এই সব বিষয়েই আলোচনা হতো। আমাদের এই আলোচনা মীরার লুকিয়ে শুনত। একদিন হটাৎই সে আমাকে ডাকে। আমি একটু অবাকই হয়ে গিয়েছিলাম। কাছে যেতে সে আমাকে জানাল যে সে প্রায় প্রতিদিন আমাদের আলোচনা শোনে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে সে উদ্বুদ্ধ। আমার কাছে সে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে।
জানিস সৌম্য মীরা যে দেখতে খুব সুন্দরী রূপবতী ছিল তা নয় কিন্তু তার চাঁউনি ছিল অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত। সাহিত্যের তার অসম্ভব দখল ছিল। আওয়ামী লীগে যোগ দিতে খুব তাড়াতাড়িই সে সবার কাছের হয়ে উঠল। পার্টির নির্দেশ মতো আমরা একসঙ্গে কাজ করতে লাগলাম। এই সময় কখন যে আমরা একে অপরকে ভালোবেসে ফেললাম তা আমরা নিজেরাও বুঝতে পারি নি।
২৬সে মার্চ, ১৯৬৯ তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আয়ুব খানকে সরিয়ে সেই পদে বসেন পাক আর্মির কমান্ডার ইন চিফ ইয়াহিয়া খান। আর তারপর তিনি ১৯৬২ সালে গৃহীত সংবিধান বাতিল করেন। তখন থেকেই আপামর পূর্ব পাকিস্তানবাসী দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। সেই বছরের শেষের দিকে পার্টির উপর মহল থেকে আমাদের কাছে খবর আসে যে আগামী এক বছরের মধ্যে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে আমরা যেন এখন থেকেই তার জন্য নির্দিষ্ট কর্মসূচি শুরু করে দিই। ফলে আমরা পার্টির কাজে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
সেই বহুকাঙ্খিত ঘোষনা খুব তাড়াতাড়িই হল। ১৯৭০ সালের ৩১ শে মার্চ রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান একটি লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার ঘোষণা করেন যাতে দুই পাকিস্তানের (পূর্ব আল পশ্চিম) একটি অবিচ্ছিন্ন আইনসভার জন্য সরাসরি নির্বাচন করার কথা ঘোষণা করা হয়। ঠিক হয় ভোট হবে ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭০। সারা দেশ খুশিতে মেতে উঠল। আমরা যারা পার্টির কর্মীরা ছিলাম তাদের কর্মব্যস্ততা আরও বেড়ে গেল। লড়াই মূলত দুই দলের- পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ যার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর পশ্চিম পাকিস্তানের পাকিস্তান পিপলস পার্টি যার নেতা ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো।
সাধারন নির্বাচনের ঠিক এক মাস আগে ঘটে গেল এক ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সে বছর ৩রা নভেম্বর বাংলাদেশের বুকে আছড়ে পড়ল ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণনাশক ঘূর্ণিঝড় 'ভোলা'। কয়েক মিনিটের মধ্যে 'ভোলা' পূর্ব পাকিস্তানকে তছনছ করে দিল। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ প্রাণ হারাল। সে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। কোথাও বাচ্ছা শিশু খিদের জ্বালায় কাঁদছে, তার মা-বাবার কোনো খবর নেই। কোথাও সন্তানহারা মা বিলাপ করছে। গাছপালার ভিতর থেকে শুধু লাশ বেরুচ্ছে। আমরা নেমে পড়লাম উদ্ধার কাছে। মীরার নেতৃত্বে তৈরী হলো ত্রাণ সংগ্রাহক কমিটি। তাদের সংগ্রহ করা ত্রাণ আমরা উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা দুর্যোগ কবলিত এলাকায় বিলি করতাম। এদিকে এতো বড় দুর্যোগের পরের ইয়াহিয়া সরকার যেন নির্বিকার। সরকারের তরফ থেকে এতোটুকু সাহায্য পাওয়া গেল না। বাঙালিরা এতো দিনে পরিষ্কার বুঝে গেল যে পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের কোনো মূল্য নেই। আলাদা বাংলাদেশের স্বপ্নটা আরও তীব্র হলো। জেনারেল ইয়াহিয়ার এই অমানবিক আচরণর প্রতিবাদে ও দ্রুত ত্রাণ ও পুনর্বাসনের দাবিতে ১৯ শে নভেম্বর ঢাকা শহরে ছাত্র মিছিলের ডাক দেওয়া হলো। পুরোধায় যথারীত আমি আর মীরা। প্রতিটা দিন, প্রতিটা আন্দোলন আমার আর মীরার সম্পর্কটা মজবুত করছিল। ভালোবাসারও উপরে আমরা একে অপরকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতাম।
এর কিছুদিনের মধ্যেই এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী ৭ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হল সাধারণ নির্বাচন। তখনও আপামর বাঙালির হৃদয়ে বঞ্চনার দগদগে ঘা স্পষ্ট। বাঙালির যাবতীয় রাগ, বেদনা, ঘৃণা আছড়ে পরল ব্যালট বাক্সে। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬০ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল আওয়ামী লীগ আর ভুট্টোর পিপিপি পেল মাত্র ৮১ টা আসন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা পূর্ব পাকিস্তানে নেতার হাতে শাসনভার ছেড়ে দিতে রাজি ছিল না। তারা নানা অজুহাতে সরকার গঠনে বাগড়া দিতে থাকল। ভুট্টো বুঝতে পেরেছিল যে অবিভক্ত পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী হওয়া তার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। ফলে সে বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্যে এক সুত্র দিল 'উধার তুম, ইধার হাম', অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু হন আর পশ্চিম পাকিস্তানের ভুট্টো। যা ছিল কার্যত অবাস্তব প্রস্তাব। স্বভাবতই আওয়ামী লীগ তা মেনে নিল না। আর এই প্রস্তাবই বাঙালি মনে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা স্বাধীনতার আগুনকে দাউদাউ করে জ্বালিয়ে দিল।
এর পরেই শুরু হল আরও বৃহত্তর ষড়যন্ত্র। সারা পূর্ব পাকিস্তানে এক কথায় অঘোষিত কার্ফু জারি হয়ে গেল। শুরু হলো সাধারন মানুষের উপর পাক বাহিনীর নির্মম নির্যাতন। তাতে অবশ্য কি বাঙালিও মদত দিয়েছিল। সকলেই তখন বুঝে গিয়েছিল যে এবার আমাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে নামা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। শুধু আনুষ্ঠানিক ভাবে সেই লড়াই শুরু হওয়া বাকি ছিল মাত্র। খুব শিগগিরই তা হয়ে গেল। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশ্যে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। সেই ভাষণে বিভিন্ন দাবির উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম"। তার এই ভাষণ গোটা জাতিকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উন্মাতাল করে তোলে। শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতার লড়াই যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নামে খ্যাত।
এরই মধ্যে আমার কাছে দলের উপর মহল থেকে কয়েকটা দিন গা ঢাকা দেওয়ার নির্দেশ আসে। কিন্তু সেই মূহুর্তে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই মীরা অত্যন্ত গোপনে আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তোলে। দিন চারেক আমি তাদের বাড়িতে ছিলাম। সারাদিন আমি আর মীরা গল্প করতাম। কোন দিকে যে সময় কেটে যেত বুঝতেই পারতাম না। চারিদিকের থমথমে পরিস্থিতি আর রাস্তায় আর্মির আধিক্য বলে দিচ্ছিল যে বড় একটা কিছু ঘটতে চলেছে। ২৩শে আমার কাছে অতি সত্বর ঢাকা ছাড়ার নির্দেশ আসে। সেই রাতেই আমি ঢাকা থেকে চলে যাই। মীরাই আমাকে বাসে তুলে দিয়ে আসে। মীরার জিজ্ঞাসা করেছিল যে আবার কবে দেখা হবে, বলেছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশ আমাদের হাতছানি দিচ্ছে মীরা, খুব তাড়াতাড়িই আবার আমাদের দেখা হবে। মীরার শেষ কথা ছিল "আমি কিন্তু তোমার অপেক্ষায় রইলাম", আমার চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসে, বুকে পাথর চাপা দিয়ে স্বাধীনতার লড়াইয়ে নেমে পরি।
অনেক লুকিয়ে চুরিয়ে ২৫ তারিখ সন্ধ্যা বেলায় গ্রামে পৌঁছাই। সেদিন রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মিটিং ছিল তা বিফল হয়। মধ্যরাতে তিনি নরহত্যার নির্দেশ দিয়ে গোপনে লাহোর ফিরে যান। যে বড় কিছু ঘটার ইঙ্গিত গত কয়েক দিন ধরে নানা জায়গা থেকে আসছিল এবার পালা ছিল সেই ঘটনা ঘটার। মধ্যরাত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী শুরু করে 'অপারেশন সার্চলাইট' নামের গণহত্যাযজ্ঞ। সেই নরসংহারের খবর যাতে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে না পৌঁছায় সেই উদ্দেশ্যে আগেই সমস্ত বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়। সারা ঢাকা জুড়ে পাক বাহিনী নির্বিচারে হত্যালীলা চালায়। এর দিন দুয়েক পর দলের গোপন দূত মারফত বিস্তারিত খবর পেলাম। জানলাম যে ঢাকার প্রায় সমস্ত ছাত্রাবাসনগুলো ছিল ওদের প্রধান লক্ষ্য। আমাদের জগন্নাথ আবাসন ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলা হয়। প্রায় ৬০০ থেকে ৭০০ ছাত্রকে নির্মমভাবে খুন করা হয়। কিন্তু যে খবরটা আমাকে সবচেয়ে আঘাত করে তা হলো, আমার খোঁজে ওরা মীরাদের বাড়ি গিয়েছিল আর আমাকে না পেয়ে ওদের প্রত্যেককে গুলি করে মেরেছে। এই খবর শোনা মাত্র আমার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো। বুকের ভিতরটা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। আমি স্থবির হয়ে গেলাম। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিলাম। নিজেকে একটা ঘরে বন্দি করে ফেললাম। আমার মা-বাবা শত চেষ্টা করেও আমাকে স্বাভাবিক করতে পারল না। আমি শুধুই ভাবছিলাম যে মীরাদের এই পরিনতির জন্য আমিই দায়ী। যদি আমি ওকে এসবের মধ্যে না জড়াতাম, যদি আমি ওদের বাড়িতে সেই কটা দিন আশ্রয় না নিতাম তাহলে ওদের এই ভাবে খুন হতে হত না।
এরই মধ্যে ঘটে গেল আর একটা ঘটনা। আমার এক তুতো দাদাকে আমি মনে করে পাক বাহিনীর খুন করল। এই খবরে আমি আবার এক ধাক্কা খেলাম আর এই ধাক্কায় আমার যেন সম্বিত ফিরল।
সেদিন মধ্যরাতে রংপুরের পার্টির শীর্ষ নেতা শহীদুল ইসলাম ভূইয়া এলেন আমার সাথে দেখা করতে। উনি আমাকে পরামর্শ দিলেন যেন আমি যেন কিছুদিনের জন্য ভারতে চলে যাই। আমিও ভেবে দেখলাম উনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু বাদ সাধল আমার মা। মা আমাকে একা ছাড়তে নারাজ। অগত্যা ঠিক হল আমি, মা আর বাবা কিছু দিনের জন্য ভারতে চলে যাব। পরিস্থিতি বুঝে পরে ফিরে আসব। শহীদুল ভাই আমার ভারতে যাওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিলেন। আমাদের গ্রাম থেকে কাছাকাছি ভারতের বর্ডার ছিল কুচবিহার। সেই রাতেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের সঙ্গে ছিল ইশতিয়াক আহমেদ, শহীদুল ভাই-এর বিশেষ পরিচিত। ইশতিয়াক ভাই বর্ডার পারাপার করাতে রীতিমত দক্ষ ছিল। ওনার সাহায্য তিস্তা ও সতী নদী পার করে সীমান্ত পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম কুচবিহারের সিতাইয়ে। সেখান থেকে জলপাইগুড়িতে একটা বস্তিতে উঠলাম।
বছর দুয়েক আমরা জলপাইগুড়িতেই ছিলাম। এরই মধ্যে ভারতের সাহায্যে আমাদের মুক্তি বাহিনী পাকিস্তানকে আত্মসমর্পণ করাল, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ হলো, বঙ্গবন্ধু দেশের সর্বময় কর্তা হলেন। কিন্তু মীরার ঘটনা আমি ভুলতে পারি নি। সেই আঘাত আমাকে যেন একদম বদলে দিল। হাসিখুশি মিশুকে আমি হয়ে গেলাম ঘরকুণো, কারোর সাথে কথা বলতাম না। দেখেছিসই তো আমাকে আমি কেমন।"
এতক্ষণ সৌম্য মন দিয়ে সব শুনছিল, এবার মুখ খুলল, "আরিব্বাস দাদু! এতো সিনেমার গল্প মনে হচ্ছে। আমি জানতাম তোমার কোনো গোপন ইতিহাস আছে কিন্তু তুমি এতো বছর ধরে মনের মধ্যে যে এতো দুঃখ-কষ্ট পুষে রেখেছ তার বিন্দুমাত্র আন্দাজ ছিল না।"
এক গ্লাস জন খেয়ে দীপঙ্কর গ্লাসটা টেবিলে রেখে বলল, "তা তুই ঠিকই বলেছিস। সিনেমাই বটে।"
"কিন্তু দাদু আজ হটাৎ আমাকে খাওয়ালে, এতো খুশি তার কারণ কি?
"এর কারন আমি আমার জীবনের সবথেকে খুশির খবর আজ পেয়েছি।"
"কি খবর?" চোখ দুটো বিস্ফারিত করে সৌম্য জিজ্ঞাসা করল।
"মীরা বেঁচে আছে আর এই কলকাতাতেই আছে" আনন্দে দীপঙ্করের চোখদুটো ভিজে গেল, চোখের কোণে জল চিক চিক করছে।
সৌম্য যেন চমকে উঠল, কয়েক সেকেন্ডে নীরবতার পর বলল, "কিন্তু দাদু তুমি তো বলেছিলে....."
সৌম্যকে থামিয়ে দিয়ে দীপঙ্কর বলল, "না না, মীরা বেঁচে ছিল। সেদিন রাতে ওদের বাড়িতে আক্রমণ হয়েছিল ঠিকই কিন্তু সেই আক্রমণে মীরা আর মীরার মা বেঁচে গিয়েছিল যদিও ওর দাদা আর বাবা মারা গিয়েছিল।"
"কিন্তু দাদু তুমি এই খবরটা কোথায় পেলে?"
"আজ মেডিকেল কলেজে গিয়েছিলাম আমার এক পুরোনো সহকর্মীকে দেখতে। সেখানে গিয়ে হটাৎ দেখা হয়ে গেল আমার এক বন্ধু সাব্বিরের সাথে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাথে পড়তাম। সে এখন ঢাকাতেই থাকে। এখানে এসেছে তার এক আত্মীয়ের চিকিৎসার জন্য। সেই আমাকে এটা জানাল।"
"কিন্তু দাদু উনি কলকাতায় কেন?"
"সাব্বির বলল, ওরা নাকি শুনেছিল যে আমাকে পাক হানাদাররা খুন করেছে। আসলে আমার নিরাপত্তার কথা ভেবে সেই সময় তেমনই কথা রটানো হয়েছিল। ওরা যে আমার সেই ভাইকে খুন করেছিল সেটা আমি বলেই মুক্তি বাহিনী প্রচার করে। ততদিন আমি অবশ্য এদেশে চলে এসেছি।"
"তারপর?" সৌম্যর গায়ে কাঁটা দিচ্ছে
"তারপর আর কি! স্বাধীন বাংলাদেশে মীরা ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগের নেতা হয়ে যায়। বছর দেড়েক পর বাড়ির চাপে শেষমেশ মীরা বিয়ে করে। বিয়ে ঢাকার আওয়ামী লীগেরই এক ব্যবসায়ী নেতা সমীরণ ভাদুড়ির সাথে। সমীরণদার সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল, উনি দলকে আর্থিকভাবে প্রচুর সাহায্য করেছেন। কিন্তু ঈশ্বর বোধহয় কাউকে সুখি দেখতে চান না। কারণ মানুষ সুখি হলে ঈশ্বরকে ভুলে যাবে। তাই মীরার জীবনে নেমে এলো আবার এক অন্ধকার।"
"কেন? আবার কি হলো?" সৌম্যকে জিজ্ঞাসা করল
"এরপর এলো সেই অভিশপ্ত রাত। পঁচাত্তর সালের ১৫ই আগস্ট ভোর রাতে বিদ্রোহী সেনারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার খুন করল। তার পরেই তারা টার্গেট করল দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের। সমীরণদা আর মীরা দুজনেই ওদের টার্গেট ছিল। ১৭ই আগস্ট সন্ধ্যা বেলায় ওরা সমীরণদার বাড়ি আক্রমণ করল ওদের দুজনকে খুন করার জন্য কিন্তু ভাগ্যবশত সেদিন মীরা তার বছর দুয়েকের ছেলেকে নিয়ে ওর মায়ের বাড়ি গিয়েছিল। তাই সে বেঁচে যায়।"
"উনি কলকাতায় কিভাবে এলেন?"
"পার্টির কিছু নেতা কর্মীদের সাহায্যে মীরা তার ছেলে, মীরার মা আর শাশুড়িকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসে। সমীরণদার তো এখানেও বিজনেস ছিল, বাড়িও ছিল।"
"আচ্ছা দাদু তোমার ওনার সাথে দেখা করতে ইচ্ছা করছে না?" উৎসুক গলায় সৌম্য জিজ্ঞাসা করল
"ওর জীবনে আমি আর ঢুকতে চাইছি না। তাছাড়া এতো বড় কলকাতা ওকে কোথায় খুঁজব!" দীপঙ্করের গলায় হতাশা স্পষ্ট হলো।
"খোঁজার চাপটা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও। তুমি বলো ওনার ছেলের নাম কি তুমি জানো?"
"না, তা কি করে জানবো!"
"আচ্ছা তোমার সমীরণদার বাড়ি কোথায় সেটা কি জানো?"
"শুনেছি তো ভবানীপুরের দিকে কোথাও।"
"ঠিক আছে দাদু, আমি দেখছি। এখন চলি, কমপিউটার ক্লাসে যেতে হবে।"
কমপিউটার ক্লাস থেকে ফিরে সৌম্য তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়ল। আজ খাবার টেবিলেও সৌম্য চুপচাপ ছিল। খেতে খেতে বাবা একবার জিজ্ঞাসা করেছিল যে সে আজ এতো চুপচাপ কেন। সৌম্য 'কিছু নয়' বলে এড়িয়ে যায়। ওর মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে যে এতো বছর ধরে বাগচি দাদু বুকের মধ্যে কতো কষ্ট বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, কেউ তা জানে না, আর সে সব না জেনে লোকে কতো কি বলে। মানুষ কারোর ব্যাপারে কিছুই না জেনেই তাকে জাজ করে। শুধু মাত্র আত্মতুষ্টির জন্যই সে এটা করে। এটি মানুষের একটা অন্যতম জান্তব প্রবৃত্তি। এই চিন্তা সৌম্যর রাতের ঘুম কেড়ে নিল। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে কিন্তু ঘুম আসছে না। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, যে করেই হোক দাদুকে তাঁর প্রেম পাইয়ে দিতেই হবে। হটাৎ তার মাথায় এলো সোশাল মিডিয়ার কথা। সঙ্গে সঙ্গে সে ধড়মড়িয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে পরল। তারপর পাশের টেবিলে রাখা ল্যাপটপটা চালু করে ফেসবুক খুলল। সার্চে গিয়ে 'ভাদুড়ী ভবানীপুর' বলে সার্চ করতেই অন্তত পঞ্চাশটা প্রফাইল সামনে এলো। সৌম্য মনে মনে ভাবল যে পঁচাত্তর সালে মীরা দেবির ছেলের বয়স যদি দুবছর হয় তবে এখন ওনার বয়স হবে বিয়াল্লিশ। তাহলে সেই মতো প্রফাইলগুলো নির্বাচন করতে হবে। এগারোটা প্রফাইল সে নির্বাচন করল। কিন্তু এই এগারোটা প্রফাইলের মধ্যে কোনটা সেই ব্যক্তির যাকে সে খুঁজছে? বসার ঘরের দেওয়ালে একাকী ঝুলতে থাকা ঘড়িটা ঢং করে একটা শব্দ করে জানান দিল যে রাত একটা বেজে গেছে। নাহ্, এবার শুয়ে পরতে হবে, মা যদি জানতে পারে এখনো জেগে আছে তাহলে ভীষণ বকবে। ল্যাপটপটা বন্ধ করে চিন্তার বোঝা নিয়ে সৌম্য শুয়ে পরল।
আজ সিধুদার দোকানে পল্লব, অনিন্দ্য, আশফাক, নিশীথরা এলেও সৌম্য আসেনি। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর সিধুদা জিজ্ঞাসা, "কিরে আশফাক তোদের পঞ্চপাণ্ডবের আর একটা কই?"
"কি জানি। আমরাও বুঝতে পারছি না গো। এক ঘন্টা হয়ে গেল আমরা এসেছি বাবুর এখনো দেখা নেই", বিরক্তির সুরে আশফাক জবাব দিল
"সিধুদা, আমাদের চারজনকেই আপাতত চা দাও, সৌম্য এলে দেখা যাবে" এই বলে নিশীথ বাকিদের দিকে তাকাতেই সকলে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল
একটা থালায় চারটে মাটির ভাঁড়ে চার কাপ চা এগিয়ে দিয়ে সিধুদা সৌম্যকে ফোন করার জন্য বলল। অনিন্দ্য জানাল যে পল্লব ইতিমধ্যেই অন্ততঃ চারবার ফোন করেছে কিন্তু সৌম্যর ফোন বন্ধ অছে।
"তাহলে তো চিন্তার বিষয়। তোরা যাবার সময় একবার ওর বাড়িতে খবর নিয়ে যাস" সিধুদাকে এখন চিন্তিত লাগছে।
পল্লবদের চা যখন প্রায় শেষের দিকে ঠিক তখনই সৌম্য এসে হাজির। তাকে দেখে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। সে দোকানে ঢুকতেই তার দিকে একের পর এক প্রশ্নের বাণ ধেয়ে এলো-
অনিন্দ্য বলল "কিরে কোথায় ছিলি?"
পল্লব বলল, "এতো দেরি কেন?"
নিশীথ বলল, "আমরা কখন এসেছি জানিস?"
আশফাক বলল, "তোর ফোনটা বন্ধ কেন?"
"সবাই মিলে একসাথে এতো প্রশ্ন করে আমি জবাব দেব কি করে! দাঁড়া আমি এই তো এলাম, দেখতেই পাচ্ছিস আমি ক্লান্ত। একটু বসি দিয়ে সব বলছি" এই বলেই সৌম্য সিধুদাকে এক গ্লাস জল আর একটা সিগারেট দিতে বলল।
সিধুদা জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, "চা খাবি না?"
"একটু পরে খাব" সিগারেটটা ধরিয়ে সৌম্য পল্লবদের উদ্দেশ্যে বলল "এবার তোদের প্রশ্নের জবাব দিই।"
"কি জবাব দেবে শালা তুমি! কাল সেই যে গেলি তারপর আর ফোন ধরিস নি, আজ আবার আউট অফ রিচ" আশফাক রীতিমতো রেগে আগুন।
"বাই দ্য ওয়ে, আশফাক আমার কোনো বোন নেই" মুচকি হেসে সৌম্য জবাব দিতেই সকলে হেসে উঠল।
"বন্ধুগন এবার একটু সিরিয়াস হতে হবে। ভীষণ জরুরি কথা আছে", সৌম্য ঠোঁটের কোণের মুচকি হাসিটা মিলিয়ে গেল, চোখ দুটো ছোট হয়ে গেল।
"কি এতো জরুরি কথা যে তুই এতো সিরিয়াস হয়ে গেলি?" পল্লব গম্ভীর হয়ে বলল।
"শোন তবে- কাল বাগচি দাদু আমাকে দেখা করতে বলে গেল না? তা আমি কাল গিয়েছিলাম-" এরপর সৌম্য ওদের সমস্ত ঘটনাটা খুলে বলল। সকলে এই ঘটনা শুনে স্তম্ভিত, তাদের মুখে কোনো রা নেই।
"এ তো রীতিমতো রোমহর্ষক সিনেমার গল্প!" নিজেকে একটু সামলে নিয়ে নিশীথ বলল।
"হ্যাঁ, ঠিক তাই। আমি ডিসাইড করেছি মীরা আন্টিকে খুঁজে বের করে এঁদের দুজনকে আবার মিলিয়ে দেব। তোরা কি আমার সঙ্গে থাকবি?"
"মানস স্যারের গাছের আম চুরি করা থেকে কাউকে না জানিয়ে বর্ধমানে ম্যাচ খেলতে যাওয়া- কোনো দিন কি আমরা তোর সঙ্গ ছেড়েছি যে আজ থাকব না?" পল্লবের কথা শেষ হতেই সকলে তাকে সম্মতি জানাল।
সৌম্য তাদের জানাল যে সে এগারোটা ফেসবুক প্রফাইল সিলেক্ট করেছে। তার একটা তালিকা সৌম্য তাদের দিল। ওরা প্রত্যেকে সেই তালিকাটা মন দিয়ে দেখল। কোথা থেকে শুরু করবে তারা? প্রত্যেকেই বেশ চিন্তিত। এমন সময় আশফাক বলল, "সৌম্য আমার সিক্সথ সেন্স বলছে সমীর ভাদুড়ীই হবে। এনাকে দিয়েই আমাদের মিশন শুরু করি আমরা"
"তোর এরকম মনে হওয়ার কারণ?" পল্লব গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করল
"দেখ, মীরা আন্টির হাজবেন্ডের নাম হল সমীরণ। 'সমীরণ' আর 'মীরা' এই দুটো নামের সাথে 'সমীর' নামটার একটা সামঞ্জস্য আছে। তাই আমার মনে হয় এনাকে দিয়েই আমাদের শুরু করা উচিৎ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই সমীরই সেই ব্যক্তি যাকে আমরা খুঁজছি", আশফাকের চোখে আত্মবিশ্বাসের ঝলক স্পষ্ট।
প্রত্যেকেই আশফাকের যুক্তির সাথে সম্মত হলো। ঠিক হলো আজই বৈকালে সৌম্য আর পল্লব ঐ ঠিকানায় যাবে। বাকিরাও এক একজন এক একটা ঠিকানায় যাবে।
বিকেল তখন সারে পাঁচটা বাজে। সূর্য প্রায় ডুবোডুবো। সৌম্যদের ট্যাক্সিটা মনে রাস্তা থেকে ডান দিকে বাঁক নিয়ে ঢুকে জগবন্ধু আশ্রমের পাশ দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে একটা বড় লোহার গেটের সামনে দাঁড়াল। সৌম্য আর পল্লব ট্যাক্সি থেকে নেমে ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গেটের সামনে এগিয়ে যেতেই দেখল কালো ফলকের উপর সোনালি অক্ষরে লেখা 'ডাঃ সমীর ভাদুড়ী' তার নিচে ডিগ্রির উল্লেখ। সৌম্যরা গেটের দিকে এগিয়ে যেতেই দারোয়ান তাদের জানাল যে ডাক্তারবাবু এখন নেই। সৌম্য সরাসরি জিজ্ঞাসা করল যে ডাক্তারবাবুর মা বাড়িতে আছেন কিনা। অন্ধকারে ছোঁড়া তীরটা ঠিক জায়গাতেই লাগল। ওরা অনুমতি নিয়ে ভিতরে গেল।
এক পরিচারিকা তাদের ভিতরে নিয়ে গেল। বসার ঘরে তাদের বসিয়ে সে চা-জল দিয়ে গেল। চা খেতে খেতে সৌম্য ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘরের চারিদিকটা দেখতে লাগল। ঘরের প্রতিটা আসবাবে আভিজাত্যের ছোঁয়া। এমন সময় এক ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা ঘরে ঢুকলেন। পরনে মেরুন পাড়ের সাদা শাড়ি, চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা, গায়ের চামড়া কিঞ্চিত শিথিল হয়ে এসেছে তবে মুখের মধ্যে একটা কাঠিন্য আছে। সৌম্য নিশ্চিত ইনিই মীরা। বৃদ্ধা ঘরে ঢুকতেই সৌম্যরা উঠে দাঁড়িয়ে হাত জড়ো করে প্রণাম করল- "আমি সৌম্য, সৌম্য বসু আর ও আমার বন্ধু পল্লব। আপনি নিশ্চয়ই মীরাদেবি?"
"হ্যাঁ, আমার নাম মীরা ভাদুড়ী কিন্তু আমি তো আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না!"
এটা শুনেই সৌম্যর মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠল, চোখ থেকে খুশির ঝলক ঝড়ে পরছে, আনন্দে ওর লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছা করছে।
নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সৌম্য বলল, "১৯৭০-৭১ সাল, ঢাকা ইউনিভার্সিটি- আপনার কি কিছু মনে পরছে?"
একথা শোনা মাত্রই মীরার মুখের গঠন পারলে গেল, চোখ দুটো কুঁচকে ছোটো করে কয়েক মূহুর্ত কিছু ভাবল তারপর সৌম্যকে জিজ্ঞাসা করল, "তোমরা কারা? কে তোমাদের পাঠিয়েছে? কি উদ্দেশ্য তোমাদের?" তারপর আশঙ্কার সুরে জিজ্ঞাসা করল, "সত্যি করে বলো তোমাদের কি ঐ রাজাকাররা পাঠিয়েছে?"
"না না। আমাদের কেউ পাঠায় নি। তাহলে আমি সরাসরি প্রসঙ্গে আসি। দীপঙ্কর বাগচিকে মনে পরে?"
মীরা চমকে উঠল। বহু বছর ধরে এই নামটা তার মনের মধ্যে পাথর চাপা ছিল। সমীরণের সাথে বিয়ের পর আর কখনোই সে এই নামটা মুখে আনে নি। অনেক চেষ্টা করেছে ভুলে থাকতে কিন্তু মনের এতো গভীরে এর শিকড় চলে গেছে যেই সে কিছুতেই দীপঙ্করকে মুছে ফেলতে পারে নি। মীরার কপালে বলিরেখা গভীর হলো, "কে তোমরা? সত্যি করে বলো তোমাদের কে পাঠিয়েছে।"
"আন্টি আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই" এতক্ষণ চুপ থাকার পর পল্লব মুখ খুলল।
সৌম্য ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, "আন্টি আমরা দীপঙ্কর বাগচি অর্থাৎ বাগচি দাদুর কাছ থেকেই আসছি।"
একথা শোনা মাত্র প্রথমে মীরা চমকে উঠল ক্ষণিকের মধ্যেই তার মুখাভিব্যক্তি পরিবর্তন হয়ে গেল, ক্রোধে তার মুখ লাল হয়ে গেল, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, "বেরিয়ে যাও তোমরা আমার বাড়ি থেকে। আমার দুর্বলতা নিয়ে মজা করার অধিকার তোমাদের কে দিয়েছে! এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাও না হলে দারোয়ান দিয়ে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবো।"
পল্লব আর সৌম্য এক চরম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো। ওরা এইরকম কিছু ঘটতে পারে বলে কল্পনাও করে নি। কোনো রকমে সামলে নিয়ে সৌম্য বলল, "আন্টি আপনি শান্ত হন। আমরা মিথ্যা বলছি না।"
"না তোমরা মিথ্যা বলছ। সে অনেক আগেই-" কথা শেষ করতে পারল না মীরা, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
"না না না। আপনি ভুল জানেন, বাগচিদাদু বেঁচে আছেন আর এই কলকাতাতেই আছেন। তবে আমাদের উনি পাঠাননি, উনি জানেনও না আপনি কোথায় থাকেন। সবে কাল উনি জানতে পেরেছেন যে আপনি বেঁচে আছেন আর কলকাতাতেই আছেন", সৌম্য এক নিঃশ্বাসে বলে গেল।
"তোমরা সত্যি বলছ?" কান্না থামিয়ে বলল মীরা
"একশ শতাংশ সত্যি বলছি আমরা। আপনি চাইলে আমরা আপনাকে ওনার ছবি দেখাতে পারি, সৌম্যর মোবাইলে আছে" পল্লবের কথা শেষ হতেই সৌম্য তাড়াতাড়ি পকেট থেকে তার মোবাইলটা বের করে মীরার দিকে এগিয়ে দিল। চোখের জল মুছতে মুছতে ছবিগুলো মীরা যেন প্রাণ ভরে দেখল। হ্যাঁ, সেই মুখ, সেই চোখ, সেই করুন চাঁউনি- এ ছবি তার দীপঙ্করের ছাড়া আর কারোর হতে পারে না। ছবি দেখতে দেখতে মীরা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো, যেন তার মনের ভিতরে জমে থাকা বহু বছরের দুঃখ-কষ্ট তার কান্নার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এলো। সৌম্য কিছু বলতে যাবে এমন সময় পল্লব তাকে ইঙ্গিতে চুপ থাকতে বলল। এই মুহূর্তে মীরাকে তার ইচ্ছা মতো কাঁদতে দেওয়াই উচিৎ তাতে তার মনের ভিতরে বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা বেদনা বেরিয়ে যাবে, মন হাল্কা হবে।
মিনিট দশেক হয়ে গেল কেউ কোনো কথা বলে নি, সবাই চুপ। মীরা অনেক কষ্টে কান্না থামিয়ে নিজেকে একটু সামলে নিয়েছে। এই মুহূর্তে ঘরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। সেই নিস্তব্ধতা ভাঙল মীরার কথায়, "সৌম্য, আমি তোমাদের সাথে যাবো, এখুনি।"
অবশ্যই, চলুন। বাকি কথা আমি ট্যাক্সিতে যেতে যেতে বলব।"
দীপঙ্করের আবাসনের সামনে এসে ট্যাক্সিটা থামল। ট্যাক্সি থেকে নেমে পল্লব সৌম্যকে জানাল যে তার ভিতরে যাওয়া উচিৎ হবে না কারন দীপঙ্করের সাথে তার সেভাবে কোনো পরিচয়ই নেই। সৌম্য তাকে বলল সে যেন বাকিদের নিয়ে সিধুদার দোকানে অপেক্ষা করে, সে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের সাথে যোগ দেবে। মাথা নেড়ে পল্লব সেখান থেকে বিদায় নিল। মীরাকে নিয়ে সৌম্য ভিতরে গেল। ফ্লাটের সামনে গিয়ে সৌম্য কলিং বেল টিপতেই সঙ্গে সঙ্গে দীপঙ্কর দরজা খুলল যেন দরজা খোলার জন্য তৈরীই ছিল।
"কিরে তুই? এমনিতে তো পান-সুপারি দিয়ে নেমন্তন্ন না করলে তুই আসিস না। এখন নিজে থেকেই হাটাৎ কি ব্যাপার?"
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেই সৌম্য জবাব দিল, "দাদু, তুমিও তো দশবার বেল না বাজালে দরজা খোলো না এখন বেল বাজাতে না বাজাতেই খুললে কি ব্যাপার?"
"আরে আমি একটু বেরোচ্ছি। ভাবছি একবার লোকাল থানায় যাব।"
"থানায়! থানা কেন?"
"দেখি মীরাকে খুঁজে বের করতে পুলিশ কোনো সাহায্য করে কি না।"
"তার জন্য থানায় যাওয়ার দরকার নেই। সৌম্য হ্যা না" মুচকি হেসে সৌম্যর বলল
"তুই কি করবি?"
"কি করব নয়, জিজ্ঞাসা করো কি করেছি"
"ঠিক আছে, কি করেছিস?"
"কি করেছি তুমি নিজের চোখেই দেখো" বলে সৌম্য ইশারা করতেই মীরা পাশ থেকে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
"দেখো তো দাদু চিনতে পারো কি না"
দীপঙ্কর বিস্ময় চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে রইল। মীরাও বিহ্বল। দুজনের চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়ছে। এ যেন চোদ্দ বছরের বনবাসের পর উর্মিলা আর লক্ষণের মিলন। কিন্তু উর্মিলা ও লক্ষণ দুজনেই জানতেন যে চোদ্দ বছর পর আবার তাদের দেখা হবে কিন্তু দীপঙ্কর আর মীরা এতোদিন দুজন দুজনকে মৃত ভেবে এসেছে তাই তাদের মনের মধ্যে কোথাও দেখা হওয়ার কোনো সম্ভবনাই ছিল না। এহেন অসম্ভব ঘটনা যখন হটাৎই সম্ভব হয়ে যায় তখন তার অনুভূতিটাই আলাদা হয়। এই অনুভূতি ওরা দুজনের কেউই মুখে প্রকাশ করতে পারছিল না।
হটাৎ সৌম্যর ডাকে দুজনের সম্বিত ফিরল, "ও দাদু, তুমি কি আমাদের বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে নাকি?"
"তাই তো, দেখেছিস! আয় আয় ভিতরে আয়। মীরা, ভিরতে এসো।"
ভিতরে গিয়ে ওরা সোফায় বসল। দীপঙ্করকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় লাগছে। সে কিভাবে মীরাকে অভ্যর্থনা করবে, কিভাবে এই সন্ধ্যাটা উজ্জাপন করে কিছুই তার মাথায় ঢুকছিল না। মীরা ব্যাপারটা বুঝতে পারল, "এতো ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। তুমি দুদণ্ড বোসো এখানে।" ইতস্ততঃ করতে করতে দীপঙ্কর একটা চেয়ারে টেনে নিয়ে টি টেবিলে উল্টো দিকে বসল।
"আচ্ছা সৌম্য এই অসাধ্য সাধন তু কি করে করলে বল তো" দীপঙ্করের কথা শেষ হতেই সৌম্য কাঁধ ঝাঁকিয়ে জমার কলারটা তুলে মজার ছলে বলল, "দাদু, আমরা হচ্ছি একবিংশ শতাব্দীর যুবক, আমাদের কাছে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়" বলেই হেসে উঠল। সৌম্যর সাথে মীরা ও দীপঙ্কর দুজনেই হেসে উঠল। এতক্ষণে ঘরের ভিতরের গুমোট ভাবটা কেটে যেন একটা শীতল হাওয়া বয়ে এলো। এরপর সৌম্য মীরাকে কি ভাবে খুঁজে পেল সেটা সংক্ষেপে জানাল।
"তোদের যে আমি কি ভাবে ধন্যবাদ জানাব তা আমার জানা নেই। ওদের সবাইকে বলবি যে তোদের আমি একটা এমন পার্টি দেব যে তোরা সারা জীবন ভুলবে না।"
"ঠিক আছে সে দেখা যাবে আমি এখন উঠি।"
"সে কি! কেন? মীরা একটু অবাক হলো
"আন্টি, আমি সেই কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। মা খুব চিন্তা করবে। একবার বাড়িতে দেখা করে আসি। চিন্তা করবেন না আন্টি, আপনা যখন আমি নিয়ে এসেছি তখন আপনাকে পৌঁছে দেবার দায়িত্বও আমার"
দীপঙ্করের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সৌম্য সোজা সিধুদার দোকানে চলে গেল। সেখানে ইতিমধ্যেই বাকিরা হাজির। সৌম্য সেখানে পৌঁছতেই সকলে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকাল।
"কিরে, এতো তাড়াতাড়ি চলে এলি?" আশফাক সৌম্যকে জিজ্ঞাসা করল।
"ওনাদের এতোদিন পর দেখা হলো। ওনাদের মাঝে কি আমার থাকা ঠিক? তাই চলে এলাম।"
নিশীথ আশফাককে বলল, "সত্যি আশু, তো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়র জোর আছে! এটা আমি তো ভাবতেই পারি নি। কি বল তোরা?"
সকলে সম্মতি জানাল। সৌম্য সিধুদাকে এক কাপ চা দিতে বলে অনিন্দ্যর কাছে একটা সিগারেট চাইল। সিগারেটটা ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে এক চুমুক চা খেল তারপর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, "বুঝলি দাদু বলেছে আমাদের একটা পার্টি দেবে, এমন পার্টি যা আমরা সারা জীবন ভুলব না।"
"তাই নাকি! সৌম্য দেখবি যেন বিরিয়ানি থাকে মেনুতে" আবদারের সুরে আশফাক বলতেই সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
সৌম্য বেরিয়ে যেতেই দীপঙ্কর মীরাকে বলল, "তুমি বোসো, আমি চা বানিয়ে আনছি।"
"এখানে একা বসে থাকব কেন? আমিও তোমার সাথে তোমার রান্নাঘরে যাই চলো"
চা বানাতে বানাতে দুজনে তাদের স্মৃতির গভীরে ডুব দিল। মীরা দীপঙ্করকে বলল, "তোমার মনে আছ যখন তুমি আমাদের বাড়িতে আন্ডারগ্রাউন্ড ছিলে তখন রান্নাঘরে আমি রান্না করতাম আর সেখানে বসে বসে আমার সাথে গল্প করতে?"
"তা আবার মনে থাকবে না! গল্প করতে করতে ঘন্টার পর ঘন্টা কি ভাবে কেটে যেত জানতেই পারতাম না।"
"আচ্ছা দীপঙ্কর, তুমি বিয়ে করলে না কেন?"
"হুম, আমার আবার বিয়ে। জীবনের একটা বড় সময় তো অবসাদগ্রস্ত হয়েই কাটিয়ে দিলাম। জানো তোমার মৃত্যু খবরটা আমি মন থেকে একদম মেনে নিতে পারে নি। ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। তোমার স্মৃতি নিয়েই জীবনের এতোটা বছর কাটিয়ে দিলাম।"
দুজনে দু'কাপ চা নিয়ে বসার ঘরে ফিরে এলো।
"আমি কিন্তু একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি"
"কি সিদ্ধান্ত?" জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দীপঙ্কর মীরার দিকে তাকাল।
"শেষ জীবনটা আমি তোমার সাথেই কাটাতে চাই। আমাকে বিয়ে করবে তো?"
কি বলছ মীরা! তুমি আমাকে বিয়ে করবে? এ তো আমার কাছে স্বর্গ পাওয়া" আবেগে দীপঙ্করের গলা বুজে এলো। সে এটা কল্পনাও করে নি। সারা জীবন যে দুঃখ ভোগ করে শেষ জীবনে তাকে ঈশ্বর হয়তো এভাবেই সুখ ঢেলে দেন।
এমন সময় সৌম্য ফিরে এলো। সে জানালো রাত সারে আটটা বাজে, এবার তাদের বেরোনো উচিৎ।
মাস খানেক কেটে গেছে, দীপঙ্কর আর মীরা এখন নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ করে। কখনো প্রিন্সেপ ঘাটে, কখনো ময়দানে বা কখনো পার্কস্ট্রীটের কোনো আভিজাত রেস্তরাঁয়। ওরা যেন তাদের যৌবন ফিরে পেয়েছে। দীপঙ্কর আর মীরা ঠিক করল সামনের মাসের পঁচিশ তারিখ কালিঘাটের মন্দিরে তারা বিয়ে করবে। দীপঙ্করের মনে কিন্তু এখনো কিছুটা সংশয় থেকে গেছে। সংশয় অবশ্যই মীরাকে নিয়ে নয় সংশয় মীরার ছেলে সমীরকে নিয়ে। সমীর কি এটা মেনে নেবে? মীরা তো এখনো সমীরকে কিছুই জানায় নি। সে যখন জানবে তখন তার প্রতিক্রিয়া কি হবে, এইসব সাত পাঁচ চিন্তা তার মাথায় ঘুরছে। মীরাকে তার এই সংশয়ের কথা জানাতে মীরা বলেছে বলেছে যে সমীরের কি প্রতিক্রিয়া হবে সে জানে না কিন্তু সে তার সিদ্ধান্তে অটল। মীরার কথা শুনে বোঝা যায় যে তার সাথে সমীর সম্পর্কে তেমন উষ্ণতা নেই বরং শীতলতাই বেশি। তবে দীপঙ্কর এ ব্যাপারে মীরাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। সে যখন এই প্রসঙ্গে কিছু বলা উচিৎ মনে করবে তখন সে নিজেই বলবে। যে কোনো সম্পর্কে ভালোবাসার সাথে একে অপরের প্রতি সম্মান থাকাও অত্যন্ত জরুরী। সেই সম্মান, সেই শ্রদ্ধা যে দীপঙ্কর আর মীরার একে অপরের প্রতি যথেষ্ট আছে তা বলাই বাহুল্য।
হাতে আর মাত্র এগারোটা দিন। মীরার মনে মনে ভাবল এবার সমীরকে দীপঙ্করের ব্যাপারে জানানো দরকার। সে জানে সমীরের তার প্রতি ভালোবাসা বা সম্মান কিছুই নেই। সে আর তার স্ত্রী চন্দ্রাণীর ভালোবাসা শুধু মাত্র তার সম্পত্তির উপর। এতো বড় বাড়িতে ছেলে, বৌমা, ছোট্ট নাতনি, পরিচারক-পরিচারিকা সকলের মাঝেও সে বড় নিঃসঙ্গ। একাকিত্ব, মানসিক যন্ত্রণা যখন তাকে একটু একটু করে শেষ করে দিচ্ছিল ঠিক তখনই সৌম্যকে যেন ঈশ্বর তাঁর দূত হিসেবে পাঠালেন। সৌম্য এক লহমায় মীরার মনে তার নিজের জীবনের মূল্যায়নটাই বদলে দিল। মীরা যখন তার জীবনকে সুখহীন এক ব্যর্থ জীবন হিসেবে মূল্যায়ন করে ফেলেছে তখনই 'দেবদূত' সৌম্যর মাধ্যমে দীপঙ্করের খবর পাঠিয়ে ঈশ্বর তাকে বুঝিয়ে দিলেন যে সে বড্ড তাড়াহুড়ো করে ফেলেছে, জীবনের এখনো একটা মোড় বাকি আছে যা তাকে সুখে, শান্তিতে ভরিয়ে দেবে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অস্থির মনটাকে শান্ত করার জন্য মীরা কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করল, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনটাকে শক্ত করল, আজ সমীরকে সে সব বলবেই। সন্ধ্যাবেলায় সমীর ঘরে ফিরতেই মীরা তাকে বলল যে সে কিছু কথা বলতে চায়। কিন্তু সমীর জানাল যে সে এখন ক্লান্ত, এই মুহূর্তে কোনো ফালতু কথা শোনার মতো সময় বি ইচ্ছা তার কাছে নেই।
কি! আমার কথা ফালতু, তোর কাছে আমার কথার কোনো মূল্য নেই?" চিৎকার করে ক্ষোভে ফেটে পড়ল মীরা তারপর বলল, "তোকে এখুনি শুনতে হবে, এটা আমার ভবিষ্যতের কথা"
"হুম! তোমার কি ভবিষ্যতের কিছু বাকি আছে? বেশ বলো" সমীরের চোখে মুখে অবজ্ঞার ছাপ স্পষ্ট।
মীরা দীপঙ্কর আর দীপঙ্করের সাথে তার সম্পর্কের কথা সব সমীরকে জানাল আর তারপর বলল যে তারা আগামী পঁচিশ তারিখে বিয়ে করছে। একথা শুনে পিছন ঘুরে থাকে সমীর তার মায়ের দিকে একবার ঝট করে ঘুরে দেখল তারপর বলল, "তোমার যা ইচ্ছা করো তবে দয়াকরে এসবের মধ্যে আমাকে টেনো না।"
এতক্ষণে মীরার নিজেকে একটু হাল্কা লাগছে, মনের মধ্যে যে খচখচানিটা ছিল সেটা চলে গেছে।
সমীর গটগট করে উপরে উঠে গেল। শোয়ার ঘরে যেতেই তার স্ত্রী চন্দ্রাণী তাকে বলল, "বুড়ি কি বলছিল?" সমীর চন্দ্রাণীকে সব খুলে বলল তারপর বলল সে জানিয়ে দিয়েছে যে এসবের মধ্যে সে নেই। একথা শোনা মাত্রই চন্দ্রাণী কপাল চাপড়াতে লাগল, "এ কি সর্বনাশ করলে তুমি!" চাপা গলায় বলল চন্দ্রাণী।
"কেন? সর্বনাশের আবার কি করলাম?"
চন্দ্রাণী একবার চট করে ঘরের পর্দাটা সরিয়ে বাইরেটা দেখে নিল, তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিয় বলল, "তোমার মাথায় কি গোবর আছে? ভেবে দেখেছ তোমার মা তার ঐ পুরনো নাগরের সাথে বিয়ের পর সব সম্পত্তি যদি তার নামে লিখে দেয় তখন কি হবে?"
"এটা তো আমি ভেবে দেখিনি। আমি এখুনি গিয়ে মাকে বলে আসছি যে এতে আমার মত নেই"
'আ হা রে! উনি বলবেন আর উনার মাও শুনে নেবেন! এ যেন তেল পারা খেজুর গাছ!"
"তাহলে কি করব?"
"খুন" চন্দ্রাণীর চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠল
"কি বলছ! মাকে খুন করব?" সমীর চমকে উঠল
"তোমার মাথায় সত্যিই গোবর আছে। কি করে যে আমার বাবা তোমার মতো একটা হাঁদারামের সাথে আমার বিয়ে দিল কে জানে! তোমার মা খুন হলে সবার সন্দেহ প্রথমেই তোমার উপর পরবে। তখন এই সম্পত্তি জেলে বসে ভোগ করতে হবে।"
"আহা রাগ করছ কেন? পরিস্কার করে বলোই না।"
"দেখ ঐ বুড়োটার তো কেউ নেই বলছ। সুতরাং বুড়োটা যদি কোন ভাবে অপঘাতে মরে তাহলে কেউ তেমন মাথা ঘামাবে না। পুলিশও ক'দিন নামে মাত্র তদন্ত করবে দিয়ে ফাইল বন্ধ করে দেবে।"
"কিন্তু চন্দ্রাণী, প্রথমে একবার কাউকে দিয়ে বুড়োটাকে শাসানি দিলে হয় না?"
"আচ্ছা গাড়ল তো তুমি? তাহলে সবাই জেনে যাবে না যে তুমি এই বিয়ের বিরুদ্ধে? পড়ে ঐ লোকটা যদি বাথরুমে পড়ে গিয়ে মরে তাহলেও লোকে তোমাকেই সন্দেহ করবে।"
"এটা তো ভেবে দেখিনি। ঠিক আছে আমি ব্যাবস্থা করছি।
বিয়ের আর সপ্তাহ খানেক বাকি। দুজনের ব্যস্ততা তুঙ্গে। তবে বিয়ের যাবতীয় ব্যাবস্থাপনায় আছে 'টিম সৌম্য'। ওরা পাঁচ জনে মিলেই রিসর্ট ভাড়া করা থেকে গাড়ি, ডেকরেশন, ক্যাটারিং সমস্থ কিছু দেখভাল করছে। বিয়েটা কালীঘাটে হবে ঠিকই কিন্তু রিসেপশনের অনুষ্ঠানটা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ করার পরিকল্পনা হয়েছে। শহরের উপকণ্ঠে একটা রিসর্ট ভাড়া করা হয়েছে, পাড়া থেকে সকলকে সেই রিসর্টে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুটো লাক্সারি বাসও করা হয়েছে সঙ্গে আরও দুটো এসইউভি। একটা বর-কনের জন্য আর একটা সৌম্যদের পাঁচ জনের জন্য। দীপঙ্করের এমনই নির্দেশ ছিল।
বিকেলে দীপঙ্করের ফ্লাটে সে মীরার সাথে বসে নিমন্ত্রণের তালিকায় একবার অন্তিম বারের মতো চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল যাতে কেউ বাদ না চলে যায়। ঠিক সেই সময় কলিং বেলটা বেজে উঠল। দীপঙ্কর দরজা খুলতেই অকস্মাৎ তার উপর একজন ঝাঁপিয়ে পড়ল। লোকটা অন্ততঃ ছ'ফুট লম্বা, মুখটা কালো কাপড়ে ঢাকা। দীপঙ্কর এই বয়সেও বেশ শক্তিশালী, যুবক বয়সে অনেক ট্রেনিং, অনেক লড়াই করেছে। দুজনের ধস্তাধস্তি দেখে মীরা ছুটে এসে দীপঙ্করকে বাঁচানোর চেষ্টা করতেই লোকটা বেগতিক বুঝে ভোজালি দিয়ে মীরাকে আক্রমণ করল। এতে মীরার ডান হাতের বাহুটা মারাত্মক আহত হলো। এই দেখে দীপঙ্কর যেন দিক্বিদিক জ্ঞান শূণ্য হয়ে গেল, তার ভিতরকার ঘুমন্ত জানোয়ারটা জেগে উঠল। সে সেই লোকটার হাত থেকে ভোজালিটা কেড়ে নিয়ে হিংস্র প্রাণীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল আর তারপর এলোপাথারি ভোজালির কোপে নৃশংস ভাবে লোকটাকে মেরে ফেলল। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে তাদের সব সপ্ন ভেঙে চুরমার। তাদের আনন্দের মুহূর্তগুলো এক লহমায় সীমাহীন হতাশায় বদলে গেল। সম্বিত ফিরতেই দুজনে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল।
আট মাস হয়ে গেল কোর্টে কেস চলছে। ঘটনার নৃশংসতা যে বর্ণনা কোর্ট শুনেছে আর যা তথ্য-প্রমান পুলিশ কোর্টের সামনে পেশ করেছে তার বিচার করে দীপঙ্করের যে মৃত্যুদণ্ড হবে তা এক প্রকার সবাই নিশ্চিত। এই ঘটনাটা চারিদিকে ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তাই আজ ২১সে মে রায় বেরোনোর দিন কোর্টে বেশ ভিড় হয়েছে। সাধারণ জনগণ, মিডিয়া থেকে শুরু করে মানবাধিকার কর্মী, এজলাস আজ গমগম করছে। জনগণের সহানুভূতি কিন্তু সম্পূর্ণভাবে দীপঙ্করের পক্ষে কিন্তু কোর্ট তো সহানুভূতিতে চলে না, কোর্টের কাছে সাক্ষ-প্রমাণই শেষ কথা। রায় রায় ঘোষণা হলো, প্রত্যাশা মতোই ফাঁসির আদেশ। আগামী ৩১সে মে ফাঁসির দিন ধার্য হলো তার আগে অবশ্য চাইলে উচ্চ আদালতে আবেদন করার ছাড় দেওয়া হলো।
পরের দিন সকালে মীরা আর সৌম্য গেল জেলে দীপঙ্করের সাথে দেখা করতে। সৌম্য মীরাকে বলল, "আন্টি আপনি আগে দেখা করে আসুন আমি তারপর যাবো।"
মীরা দেখল এক মুখ দাড়ি নিয়ে দীপঙ্কর গারদের রড ধরে দাঁড়িয়ে আছে, মাথাটা একেবারে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। মীরা যেতেই দীপঙ্কর মাথাটা তুলল। নিঃশব্দে চোখ দিয়ে দড়দড় করে জল পরছে। "মীরা কোথা থেকে কি হয়ে গেল বলো তো? কেন লোকটা আমার উপর আক্রমণ করল সেটাও জানতে পারলাম না। মুহূর্তের মধ্যে সব কেমন বদলে গেল!"
মীরার কান্না যেন থামছে না, কোনোরকম বলল, "তোমার ফাঁসি হয়ে গেলে আমিও আত্মহত্যা করব। একা একা বাঁচার আর কোনো ইচ্ছা আমার নেই।"
একথা শোনা মাত্র দীপঙ্করের মুখটা একদম পাল্টে গেল, মীরাকে বলল, "মীরা তুমি আমাকে দারুণ কথা বললে। বেঁচে থেকে না পারলেও মরে গিয়ে তো আমরা মিলিত হতেই পারি। সেখানে কে আটকাবে আমাদের। আঃ শান্তি পেলাম। এখন আর আমার কোনো আফসোস নেই। আমি মরে শান্তি পাবো।"
ঠিক হলো ঠিক যে মুহূর্তে দীপঙ্করের ফাঁসি হবে সেই মুহূর্তেই মীরাও আত্মহত্যা করবে।
মীরা চলে যেতে সৌম্য এলো দেখা করতে বিভিন্ন কথার মাঝে সৌম্য জানাল যে বিভিন্ন সংবাদপত্রে, খবরের চ্যানেলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই রায়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছে। দীপঙ্কর মনে মনে ভাবল যে তারা যতই প্রচার চালাক তার ফাঁসি কেউ আটকাতে পারবে না কারন সে উচ্চ আদালতের কোনো আবেদন করবে না। কিন্তু নিয়তির ইচ্ছা বোধহয় অন্যরকম। সে উচ্চ আদালতের আবেদন না করলেও মানবাধিকার সংগঠনগুলো করল। তারা তাদের আবেদনে আদালতকে বলল যে দীপঙ্কর বাগচি আত্মরক্ষার জন্য এই খুন করেছে আর এই অপরাধে একজন সত্তরোর্ধ মানুষকে ফাঁসি দেওয়া মধ্যযুগীয় বর্বরতা ছাড়া আর কিছুই নয় তাই তাদের অনুরোধ আদালত যেন দীপঙ্কর বাগচির ফাঁসির আদেশ পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এই খবর শুনে দীপঙ্করের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো। বারবার তার সাথে কেন এমন হয়? কেন সে যেটা চায় তা কখনো পায় না? রাগে, দুঃখে ছটফট করতে লাগল কিন্তু কিছুতেই যেন সে শান্ত হতে পারছে না। কি করবে সে? ভেবে ভেবে এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল।
আজ ২৭শে মে। আজকের সকালটাও অন্যদিনের মতোই হলো। কিন্তু একটু বেলার পর দিনটা সম্পূর্ণ বদলে গেল। সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠল একটা খবরে। দীপঙ্কর বাগচি তার ফাঁসির আদেশ বহাল রাখার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছে, আজই তার শুনানি হবে, তার হবে সওয়াল করবে প্রখ্যাত ব্যারিস্টার লক্ষণ জালানি। এই খবর সত্যি অবাক করার মতো। কেউ কখনো শুনেছেন যে নিজেকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ানোর জন্য কেউ খরচ করে বড় উকিল নিয়োগ করে! বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও এই ঘটনা কভার করা হলো। লক্ষণ জালানি তার জীবনে কোনো কেস হারে নি। এবারও তাই হলো। সুপ্রিম কোর্ট দীপঙ্করের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখাল। খুশিতে দীপঙ্কর দুহাত তুলে নেচে উঠল। সে এখন অপ্রতিরোধ্য। তার মীরার সাথে মীলন কেউ আটকাতে পারবে না। নির্দিষ্ট দিনেই ফাঁসি হবে।
৩০শে মে ঘোষণা হলো পরের দিন সকাল সাতটায় দীপঙ্করের ফাঁসি হবে। সে দিন মীরা এলো জীবিত অবস্থায় শেষ বারের মতো দেখা করতে। দুজনে ঠিক করল পরের দিন সকালে যখন দীপঙ্করকে ফাঁসির মঞ্চে তোলা হবে তখনই মীরা বিষ খাবে। তার সব ব্যবস্থা মীরা করে রেখেছে।
আজ ভোর ভোর দীপঙ্কর উঠে পরেছে যদিও সারা রাত সে দু চোখের পাতা এক করতে পারে নি। এটাই তার এই পৃথিবীতে শেষ রাত। মনের ভিতরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। আর মাত্র দু ঘন্টা, তার পরেই সে এই পৃথিবীকে বিদায় জানাবে আর কেউ তাকে মীরার সাথে মিলিত হতে আটকাতে পারবে না। সকাল ছ'টা বেজে গেছে, আর এক ঘন্টা। এখুনি হয়তো জেলের কর্মীরা চলে আসবে, তাকে স্নান করিয়ে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাবে। সাড়ে ছ'টা বেজে গেল এখনো কেউ এলো না। এবার দীপঙ্কর একটু অস্থির হয়ে উঠল। সাতটায় তার ফাঁসি অথচ পৌনে সাতটাতেও কারোর কোনো উদ্যোগ নেই কেন? সাতটা দশ বাজে, দীপঙ্কর জেলার সাহেবকে তার সেলের দিকে আসতে দেখল। সে এবার নিশ্চিন্ত হলো, এবার নিশ্চয়ই তাকে তৈরী করা হবে, সেজন্যই জেলার আসছেন। মনে মনে ভাবল মীরা হয়তো এতক্ষণ বিষ খেয়ে নিয়েছে। জেলার তার সেলের সামনে আসতেই দীপঙ্কর বলল, "আসুন জেলার সাহেব, আমি তো কখন থেকে অপেক্ষা করছি। এতো দেরি হলো যে, আমার ফাঁসির সময় কি পরিবর্তন হয়েছে?"
জেলার বলল, "দীপঙ্করবাবু আপনার জন্য একটা খবর আছে। আপনার ফাঁসি রোধ হয়ে গেছে। মানবাধিকার কর্মীরা একত্রিত ভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছিল, রাষ্ট্রপতি সেই আবেদন মঞ্জুর করেছেন।"
দীপঙ্কর একথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখ দিয়ে একটাও কথা বেরোচ্ছে না। শরীর যেন ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। এখন তার চিন্তা তার ফাঁসি নিয়ে নয়, চিন্তা মীরার আত্মহত্যা নিয়ে। কাটা পাঁঠার মতো এখন তরফাচ্ছে সে। এ কি সর্বনাশ হয়ে গেল! সে মনেপ্রাণে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছে যেন মীরার কিছু না হয়।
কিছুক্ষণ পর সৌম্য এলো তার সাথে দেখা করতে। কাঁদতে কাঁদতে বলল, "দাদু, সর্বনাশ হয়ে গেছে। মীরা আন্টি আজ সকালে আত্মহত্যা করেছেন। আর সুইসাইড নোটে লিখে গেছেন যে তোমার সাথে পরলোকে মিলিত হবার জন্যই একাজ করলেন। এটাও লিখেছেন যে ওনার সমস্ত সম্পত্তি উনি উইল করে আমার নামে লিখে দিয়েছেন", সৌম্য হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো।
নির্বাক দীপঙ্কর ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল।
দীপঙ্কর এবং মীরা দুজনেরই মরুভূমির ন্যায় জীবনে সুখ যেন মরীচিকা, তারা যতই সুখের কাছে এগিয়ে যায় সুখ ততই তাদের থেকে দূরে সরে যায়। এখন, যখন দীপঙ্করের একমাত্র সুখ মৃত্যু তখন মৃত্যও তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আর মীরা সুখের মৃত্যু যখন আলিঙ্গন করল সুখ তার মৃত্যু হাত ছেড়ে দিয়ে চলে গেল বহুদুরে ঠিক মরীচিকার মতোই।
*অঙ্কণ : তন্দ্রা ব্রহ্মচারী
**বিধিসম্মত সতর্কীকরণ - এই গল্পের ঘটনা, স্থান, কাল, পাত্র সবই কাল্পনিক। এর সাথে যদি বাস্তবের কারোর কোনো মিল পাওয়া যায় তা নিতান্তই কাকতালীয় বলে গণ্য হবে। ধূমপান ও মদ্যপান স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর, ইহা ক্যান্সারের কারণ।