পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ২১ মে, ২০২০

ওরা পরিযায়ী শ্রমিক

ওরা পরিযায়ী শ্রমিক
                   উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী

দলে-দলে বা একা-একা, ওরা আজ নেমেছে পথে-
আজ ওরা অসহায় ভারি;
দুরত্বের কোনো হিসেব নেই, সময়ের তাদের জ্ঞান নেই-
ফিরবেই নিজ-নিজ বাড়ি।
শপথ ওদের বড্ড কঠিন, চিত্ত ওদের ভয় ডরহীন-
আজ ওরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ;
অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, নেই ওদের ন্যুনতম সংস্থান-
সরকার! সে তো অন্ধ, অজ্ঞ।
বাবা হয়েছে শ্রবণকুমার, ঘুমন্ত শিশু টানছে মা-
বইছে তাকে বাক্স চলমান;
অন্তঃসত্ত্বাও হাঁটছে সাথে, করেছে প্রসব পথের ধারে-
খুইয়েছে তার মান-সম্মান।
অতিমারিকে নেইকো ভয়, জ্বলছে ওরা খিদের জ্বালায়-
আজ ওরা বড্ড ক্ষুধার্ত;
লক্ষ কোটির প্যাকেজ আসে, অশ্বডিম্ব ওদের জোটে-
ধোকাবাজ মন্ত্রীরা ভারি ধূর্ত।
পিচ রাস্তায় জ্বলছে আগুন, মাথার উপর সূর্য প্রখর-
ফোসকা পরে পায়ের তলায়;
নেতারা সব হাড় বজ্জাত, সব ঠগ লুটেরার দল-
চোরেরাই এদেশ চালায়।
এনআরআইদের ফ্লাইট আছে, ওদের আছে দুটি পা-
হয়ে যাক এ দেশ ছাড়খাড়;
শেষনাগের ফণার মতো ওদের কাঁধও শক্তিশালী-
ওরাই বয় এদেশের ভার।
দেশ গঠনের যন্ত্র ওরা, ওরাই দেশের ভুত ভবিষ্যত-
তবু বঞ্চিত ওরা চিরকাল;
লিখতে বসলে ওদের কথা চোখ হতে বয় অশ্রু ধারা-
আসবেই নতুন সকাল।
প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, বড়-মেজো-ছোটো নেতা-
আছে তাদের অনেক গিমিক;
রাজনীতির বিভেদ ভুলে এগিয়ে এসো সকলে মিলে-
ওরা পরিযায়ী শ্রমিক।

সোমবার, ১১ মে, ২০২০

নেশা

নেশা

       উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী

ষড়রিপুর অনুঘটক সে, লোভের থেকেও সর্বনাশা;
বিনাশেরই আহ্বায়ক সে, নামটি তার নেশা।
অসম্ভবকে সম্ভব করায় তন-মনকে রেখে নিজ বসে,
সত্যকে মিথ্যা বানায়, দিনকে করে রাত দৃষ্টিভ্রমের যশে।

নেশায় তুমি মজলে পরে জ্ঞানভাণ্ডার হবে শূণ্য,
নেশার ফাঁদে পরলে তুমি ভুলবে পাপ-পুণ্য।
ছোঁয়াচ রোগের প্রাদুর্ভাবেও পথে নামে কেউ মদের খোঁজে,
অতিমারির প্রভাব ভুলে ভীড় জমায় কেউ ঈশ্বরে মজে।

বিড়ি-সিগারেট-মদ-গাঁজা, নেশার বস্তু হেরোইনও,
এসব অতি তুচ্ছ নেশা, ছাড়া অতি সহজ জেনো।
ধর্ম? সেতো আফিং বটে, এ নেশা ভয়ঙ্কর অতি,
ধর্ম তোমায় করবে স্থবির, নয়তো হবে সন্ত্রাসবাদী।

নেশার একটা গুণও আছে, লক্ষ্যে রাখে দৃষ্টি নিবদ্ধ,
চাওয়ার খিদে বাড়িয়ে দেয়, সাহস জোগায় প্রতিনিয়ত।
পূর্ণ স্বরাজের নেশায় ভারত যদি না হতো নেশাগ্রস্ত,
নিশীথ সূর্যের দেশের মানুষ ব্রিটিশরা কি এ দেশ ছাড়তো?

বৃহস্পতিবার, ৭ মে, ২০২০

মায়াবীনি

মায়াবীনি

                                                                                  উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী


                     অঙ্কন: তন্দ্রা ব্রহ্মচারী
অফিসের কর্মব্যস্ততার মাঝে বারবার ব্যাক্তিগত ফোন এলে অভয় খুব বিরক্ত হয়। যেকোনো কাজের প্রতি তার নিষ্ঠা প্রশ্নাতীত, তা সে ব্যাক্তিগত জীবনের কাজই হোক বা তার পেশাদারী দায়িত্বই হোক। আর সেই জন্য সে অফিস টাইমে কোনো ব্যক্তিগত ফোন আসুক তা চায় না। মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতেই বিরক্ত হয়ে অভয় ফোনটা তুলল, "বলো বাবা। কি? কখন থেকে?" অভয় আঁতকে উঠল। "তুমি কোনো চিন্তা কোরো না, আমি এখুনি বেরোচ্ছি" বলেই ফোনটা রেখে দিয়ে এক মুহূর্ত কিছু একটা চিন্তা করল তারপর হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল বড় সাহেবের ঘরে।
"মে আই কামিন স্যার?" ঘরের দরজাটা একটু ফাঁক করে অভয় ভিতরে যাওয়ার অনুমতি চাইল।
"আরে অভয়! এসো-এসো। কি ব্যাপার, এতো টেনশন কিসের?"
"স্যার, আমার একটু ছুটি চাই"
"তা একটু ছুটি কেন? পুরোটাই নিয়ে নাও না, কিন্তু তোমার টেনশনটা কিসের সেটা তো বলো"
"স্যার, আমার খুব বিপদ হয়ে গেছে, আমার স্ত্রীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সম্ভবত ওকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। ফোনে বাবাকে সান্তনা দিলাম বটে কিন্তু আমার মাথা একদম কাজ করছে না, কি করব কিচ্ছু ভেবে পাচ্ছি না।" কাতর গলায় অভয় জবাব দিল।
"আরে এতো বড় ঘটনা ঘটে গেছে আর তুমি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছ! তুমি ইমিডিয়েট বেরিয়ে যাও। আর শোন, তোমাকে এখন আর ট্রেনে-বাসে যেতে হবে না আমার গাড়িটা নিয়ে যাও, ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি ও তোমাকে তোমার বাড়ি ছেড়ে দেবে।"
"আপনাকে যে স্যার কি বলে যে ধন্যবাদ দেব......."
"আর ফর্ম্যালিটি করতে হবে না, তাড়াতাড়ি রওনা হও।"

গাড়িটা জাতীয় সড়ক ধরে হু-হু করে ছুটে চলেছে। রাস্তার দু'ধারে সবুজ ধানের ক্ষেত দ্রুত গতিতে পিছনের দিকে সরে যাচ্ছে। মাঝের সিটে ড্রাইভারের উল্টো দিকের জানালার ধারে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল অভয়। বার বার অপরাজিতার মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে, আর সেই সাথেই অজয় আর অর্পিতার কান্নার আওয়াজ তার কানে বাজছে। হটাৎ অভয়ের কানে একটা আপাত নিরীহ, মোলায়েম নারী কন্ঠস্বর ভেসে এল, "আমি কি অভয় মন্ডলের সাথে কথা বলছি?" সে চমকে উঠে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, "আমি তো গাড়িতেই আছি! এটা তাহলে আমার মনের ভুল", মনে মনে ভাবতেই তার বুকের ভেতরটা চিন-চিন করে উঠল, একরাশ নিঃস্বতা ঘিরে ধরল তাকে, দম বন্ধ হয়ে আসছে, অভয়ের এখন হাউহাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কোনো রকমে নিজে কে সংযত করে চোখটা বন্ধ করে বসে রইল অভয়। সময় যেন কাটছে না, আজ রাস্তাটা কেউ যেন রাবার ব্যান্ডের মতো টেনে বাড়িয়ে দিয়েছে, কতক্ষণে বাড়ি ফিরবে ভেবে ভেবে আকুল হয়ে উঠছে সে। চোখ বন্ধ করে মাথাটা এলিয়ে দিল অভয়।

অভয়ের সাথে অপরাজিতার বিয়ে হয়েছিল নাটকিয় ভাবে। যেন সিনেমার গল্প। একটা বেসরকারি কম্পানিতে চাকরি সুত্রে অভয় তখন গুজরাতের কচ্ছে থাকে। একদিন রাতে অভয়ের মোবাইলে একটা ফোন আসে। অচেনা নম্বর দেখে অভয় একটু ইতস্ততঃ করছিল, শেষমেশ ফোনটা ধরল-
"হ্যালো! কে বলছেন?"
উত্তরে ফোনের ওপার থেকে একটা আপাত নিরীহ, মোলায়েম নারী কন্ঠস্বর ভেসে এল, "আমি কি অভয় মন্ডলের সাথে কথা বলছি?"
গলার আওয়াজটা যেন অভয়ের হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল, সে কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে জবাব দিল, "হ্যাঁ বলছি। আপনি কে বলছেন?"
"আমি মহুয়া। আমাকে আপনি চিনবেন না।"
সেদিন অপরাজিতা অভয়কে তার সঠিক নামটা বলে নি। হয়তো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল।
"আমার নম্বর কোথায় পেলেন?"
"আপনারই এক বন্ধুর থেকে, তবে তার নাম এখনই জিজ্ঞাসা করবেন না, সময়মতো আমি নিজেই আপনাকে বলব।"
এইভাবে তাদের ফোনালাপ শুরু। ধীরে ধীরে ওরা দুজনে একে অপরের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল, 'আপনি' পরিবর্তিত হয়ে গেল 'তুমি'-তে। সম্পর্কের ঘনত্ব এখন অনেকটা বেড়েছে। এমনই একদিন.......
"স্যার! স্যার!" ড্রাইভারের ডাকে অভয়ের তন্দ্রা ভেঙে গেল,
"হ্যাঁ, বলো!"
"কোন রাস্তায় যাবো, সোজা না ডান দিকে?"
জানলা দিয়ে বাইরেটা একটু দেখে নিয়ে অভয় জবাব দিল, "ডান দিকে ঘোরাও।"

গাড়ি থেকে নামতেই অভয়ের উত্তেজনাটা বেড়ে গেল। হন্তদন্ত হয়ে প্রায় রুদ্ধশ্বাসে বাড়ি ঢুকতেই কানে গেল তার পাঁচ বছরের মেয়ে কাঁদছে, কোন রকমে জুতো জোড়া খুলে ভারি পর্দাটা সরিয়ে ঘরে ঢুকে দেখল অভয়ের মা খাটে বসে অর্পিতাকে ভোলানোর চেষ্টা করছে আর তার সাত বছরের ছেলে অজয় পাসে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। অভয়ের বাবা চেয়ারে বসে আছে, চিন্তায়, ক্লান্তিতে মাথাটা ঝুঁকে প্রায় হাঁটুর কাছে নেমে এসেছে।
ঘরে ঢুকতেই অভয়ের মা অভয়ের দিকে প্রায় ছুটে এলো, "এসেছিস বাবা! দেখ তো আমাদের কত বড় সর্বনাশ হয়ে গেল" বলেই হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল। বাবা হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসে কাতর সুরে অভয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, "কি হল বলত? আমার মাথায় তো কিচ্ছু ঢুকছে না"
দুঃখে, কষ্টে, চিন্তায় অভয়ের ভিতরে যেন কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যাচ্ছে কিন্তু বাবা-মা এতোটাই ভেঙে পরেছে যে তাকে প্রাণপণ চেষ্টা করে সেই ঝড়কে দমিয়ে রাখতে হচ্ছে। এইটাই তো পুরুষ মানুষের জীবন, কেঁদে হালকা হওয়া পুরুষ-ধর্ম বিরুদ্ধ। কষ্টটা ভিতরে চেপে অভয় তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, "বাবা, অপুকে (অপরাজিতাকে বাড়ির সবাই এই নামেই ডাকত) কখন থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? আমাকে সব ডিটেলে বলো"
"সকাল এগারোটা থেকে। তুই তো গোপালকে তার রিক্সা নিয়ে দশটার সময় আসতে বলে অফিস চলে গেলি। ও সময়মতো এসে অপুকে নিয়ে ইস্কুলে চলে যায়। গোপাল বলল এগারোটা নাগাদ অজয়ের ছুটি হয় তারপর তাদের দুজনকে নিয়ে ও বেরিয়ে পরে, কিছুক্ষণ পর স্টেশন বাজারের কাছে পৌঁছাতেই অপু গোপালকে দাঁড়া করিয়ে ফল কিনবে বলে বাজারের ভিতরে যায়। মিনিট পনেরো অপেক্ষা করার পর দেরি হচ্ছে দেখে গোপাল অপুকে ফোন করে, কিন্তু ওর ফোন বন্ধ ছিল। এখনো বন্ধই আছে। হ্যাঁ রে অভয়, কি হলো বলত?" চেয়ার ছেড়ে বাবা উঠে দাঁড়াল। বাবার কথা শেষ হতে না হতেই মা আবার ডুকরে কেঁদে উঠলো।
"আঃ মা, কেঁদো না চুপ করো। বাবা আমাকে এখুনি থানায় যেতে হবে। বাইকের চাবিটা দাও"
"চল, আমিও তোর সঙ্গে যাই" টেবিলের ড্রয়ার থেকে চাবিটা বের করে অভয়কে বলল ওর বাবা।
চাবিটা তাড়াতাড়ি তার বাবার হাত থেকে নিয়ে অভয় বলল, "না বাবা, তোমাকে যেতে হবে না।"
"না-না তোর বাবা যাক। ওর কথা শুনো না, তুমি যাও" মা নাছোড়।
"আমি বিমলকে বলে দিয়েছি, ও এখুনি এসে পরবে, ওকে নিয়েই যাবো।"
"তা ভালো করেছিস", বাবা একটু নিশ্চিন্ত হলো। "আচ্ছা বেয়াই মশাইকে খবর দিয়েছিস?"
"হ্যাঁ, বাবাকে বলেছি। বাবা বললেন আজ ওনার ড্রাইভার আসবে না, তাই ওরা আজ আসতে পারবে না। কাল সকালে আসবে।"
"ওদের মেয়ে নিরুদ্দেশ আর ওরা ড্রাইভারের অপেক্ষায় বসে আছে?" মা অবাক হয়ে বলল।
মাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বাবা বলল, "ওসব নিয়ে চিন্তা করার সময় এখন নয়", তারপর অভয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, "তুই আর দেরি করিস না বাবা, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পর"
কথা শেষ হতেই বিমলের আওয়াজ এলো, অভয়ের নাম নিয়ে ডাকতেই অভয় বেরিয়ে পরল।

থানায় পৌঁছে অভয় বুঝতে পারল যে কোনো না কোনো কারনে আজ থানার মধ্যে কর্ম ব্যস্ততা অন্য দিনের তুলনায় একটু বেশি, সবাই শশব্যস্ত। সে একজন হাবিলদারকে জিজ্ঞাসা করল, "স্যার, এফআইআর করার আছে, কোথায় যাব দয়া করে একটু বলবেন?"
"আজ সবাই ব্যস্ত। সামনে ভোট, সেজন্য নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকরা আসছেন। আপনি পরে আসবেন" নির্দেশে করার মতো করে হাবিলদার জবাব দিল।
এই কথা শুনেই অভয়ের পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেল। সে ক্ষোভের ফেটে পরল। চিৎকার করে বলল, "আমার স্ত্রী হারিয়ে গেছে আর আপনারা ভোট দেখাচ্ছেন? কোন সংবিধানে লেখা আছে ভোটের সময় অভিযোগ দায়ের করা যায় না? মনে রাখবেন আপনারা পাবলিক সার্ভেন্ট, জনতাকে সার্ভিস দেওয়ার বদলেই আমাদের ট্যাক্সের পয়সায় আপনাদের মাইনে হয়........." অভয় চিৎকার করতে থাকে। বিমল অভয়কে চুপ করানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতেই একজন সাব ইন্সপেক্টর সেখানে পৌঁছলেন।
"কি ব্যাপার, এতো চেঁচামেচি কিসের?"
"স্যার, দেখুন না এনাকে বললাম আজ সবাই ব্যস্ত, কোনো এফআইআর নেওয়া যাবে না, কাল আসতে আর ইনি খামোখা........"
"স্যার, আমার স্ত্রী হারিয়ে গেছে আর ইনি আমাকে ভোটের ব্যস্ততা দেখাচ্ছেন", হাবিলদারের কথার মাঝেই অভয় এসআই সাহাকে বলল।
"আপনারা আমার সাথে আসুন" এসআই সাহা অভয় আর বিমলকে ডেকে নিল।
"বসুন", চেয়ারে বসে টেবিলের উল্টো দিকে রাখা চেয়ারের দিকে নির্দেশ করে এসআই সাহা বলল।
দুজনে দুটো চেয়ারে বসল। বিমল ইন্সপেক্টরকে ধন্যবাদ জানাতেই ইনসপেক্টর বলল, "আপনার সমস্যা কি বলুন এবার।" অভয় সমস্ত ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জানাল তারপর শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, "অপরাজিতাকে পেয়ে যাব তো স্যার? দয়া করে একটু তাড়াতাড়ি এফআইআরটা দায়ের করে তদন্তটা শুরু করুন"
"দেখুন, সব কিছুর তো একটা সিস্টেমে আছে। আইন অনুযায়ী আমরা আপনার কথায় এফআইআর নথিবদ্ধ করতে পারি না। আপনার শ্বশুরবাড়ির তরফে কাউকে এই এফআইআর করতে হবে।"
"কেন? আমার স্ত্রী নিখোঁজ আর আমি তার অভিযোগ জানাতে পারি না?"
"না। কারন আবার স্ত্রীর নিখোঁজের পিছনে আপনার হাত থাকতেই পরে, এটাও তো হতে পারে যে আপনি আপনার স্ত্রীকে খুন করে গুম করে দিয়েছেন?"
"বাঃ! দেশের সংবিধান বলছে একশটা অপরাধী ছাড়া পায় পাক যেন একজন একজন নিরপরাধী শাস্তি না পায় আর এই দেশের আইনই সব স্বামীদের আগে থেকেই অপরাধী ধরে নিচ্ছে। এটা কি স্ববিরোধিতা নয় ইনসপেক্টর?"
"হয়তো আপনি ঠিক বলছেন। কিন্তু আমার হাত-পা আইনের বেড়ায় আবদ্ধ। আইনের বাইরে তো আমি যেতে পারি না।"
"কিন্তু ইনসপেক্টর........."
"তুই চুপ কর। ইনসপেক্টর আপনি বলুন এখন আমরা কি করব" অভয়কে থামিয়ে দিয়ে বিমল বলল।
এসআই সাহা একটু চিন্তা করল তারপর বলল, "আপনারা এক কাজ করুন, আপাতত অপরাজিতা দেবির মোবাইল নম্বরটা দিয়ে যান, আমি নিজের উদ্যোগে আনঅফিসিয়ালি তদন্ত কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যাই। আপনি বরং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওনার বাপের বাড়ি থেকে কাউকে আনিয়ে রিপোর্টটা লেখান।"
"আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্যার। আমার শ্বশুরমশাই আর শাশুড়ির মা কাল সকালে চলে আসবেন, আমি কাল ওনাদের সরাসরি থানায় নিয়ে আসব। চলি স্যার।" দুজনে উঠে পরল। থানা থেকে বেরোবে এমন সময় ইনসপেক্টর ডাকল, "অভয়বাবু"
অভয় ঘুরে এলো, "বলুন স্যার"
"আমার মোবাইল নম্বরটা রাখুন, বলার মতো কোনো তথ্য যদি মনে পরে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে জানাবেন। কিছু লুকোবেন না কিন্তু।"
"অবশ্যই জানাবো স্যার।"

থানা থেকে বেরিয়ে রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে দুজনে দুটো সিগারেট ধরাল। দুজনেই নিশ্চুপ। অভয়ের চোখ দুটো ছলছল করছে। সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে শূণ্যে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে অভয় বলল, "বিমল, পুলিশ ওদের মতো তদন্ত করুক, আমরা একটু আমাদের মতো করে চার দিক খুঁজে দেখি চল।"
"আমরা এখন কোথায় খুঁজব? আর তাছাড়া মাসি আর মেসো তো কাল সকালেই আসছে"
"না রে বিমল। আমাকে খুঁজতেই হবে। আমি যে ওকে ছাড়া বাঁচব না রে। ছেলে-মেয়ে দুটোর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। এখন আমি যদি পুলিশের ভরসায় বসে থাকি, নিজে খোঁজার এতোটুকু চেষ্টা না করি তাহলে আমি কি নিজের কাছেই মুখ দেখাতে পারব? ছেলে-মেয়ে দুটোকে কি জবাব দেবো? না রে বিমল, আমি পুলিশের ভরসায় নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারব না।"
"কিন্তু আমার একটা কাজ ছি..ল....."
"না-না। তুই যা। এটা আমার লড়াই, আমাকে একাই লড়তে হবে। তুই যা, তুই যা" অভয় ব্যথিত স্বরে বিমলকে জবাব দিল, তারপর মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিয়ে নিমেষের মধ্যে বিমলের চোখে অদৃশ্য হয়ে গেল।

রাত প্রায় দশটা বাজে, অভয় এখনো বাড়ি ফেরে নি। অভয়ের মা-বাবা দুজনেই খুব চিন্তিত। মা অনেক কষ্টে অজয় আর অর্পিতাকে খাইয়ে ঘুম পারিয়েছে।
"কি গো! অভির সাথে তোমার কোনো কথা হলো?" মা বাবাকে জিজ্ঞাসা করল
"নাহ্" বলে বাবা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলল, "ওর ফোনটাও তো বন্ধ, যোগাযোগ করতে পারছি না"
"একবার বিমলকে কল করে দেখো না, ও তো অভয়ের সঙ্গে আছে"
"ঠিক বলেছ, এটা তো আমার মাথায় ছিল না", বলেই বাবা সঙ্গে সঙ্গে বিমলের নম্বরে ডায়াল করল
অনেকক্ষণ কানে ফোনটা ধরে থাকতে দেখে অভয়ের মা অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, "কি গো! ফোন লাগল?"
"রিং হচ্ছে, ধরছে না। দাড়াও আর একবার কল করি"
"হ্যাঁ গো, অভির আবার কোনো বিপদ হলো না তো?" মা ত্রস্ত কন্ঠে বাবাকে জিজ্ঞাসা করল
"আরে বিপদ আবার কি হবে! তুমি অযথা ফালতু চিন্তা কোরো না"
একটা বাইকের আওয়াজ ক্ষীণ থেকে ধীরে ধীরে বাড়ছে, যেন বাইকটা এদিকেই আসছে, কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাইকটা বাড়ি সদর দরজায় এসে দাঁড়াল তারপর একটা হর্ন বাজল।
"ঐ বোধহয় অভি এলো। আমি যাই দরজাটা খুলি" মা হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মিনিট খানেকের মধ্যেই অভয় ঘরে ঢুকল, ঝোড়ো কাকের মতো অবস্থা, মাথার চুল উস্কখুস্ক, দুই কোয়াস দিয়ে যেন ফেনা কাটছে। ঘরে ঢুকতেই বাবা জিজ্ঞাসা করল, "কি রে, তোর ফোন বন্ধ কেন?"
"চার্জ নেই", সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে অভয় চেয়ারে শরীর এলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে পরল।
"বিমল কেন ফোন ধরছিল না? ওকে কি বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে এলি?"
"ওর কিছু এমার্জেন্সি কাজ এসে গিয়েছিল, তাই ও অনেকক্ষণ আগেই চলে এসেছে"
"তুই এতক্ষণ একা একা কোথায় ছিলি?" বাবা উদ্গ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করল
"খুঁজছিলাম, পেলাম না" চোখ বন্ধ করেই কাঁপা কাঁপা গলায় অভয় বলল
"বৌমাকে? কোথায় খুঁজছিলি? তুই কি পাগল হয়ে গেলি?" বাবা ধমকে বলল
"এই জন্যই আমি তোমাকে যেতে বলেছিলাম, আমার কথা তো শুনবে না!" মা বাবার প্রতি অভিযোগ করল
"হ্যাঁ বাবা, অনেক খুঁজলাম ওকে। পেলাম না।"
"কিন্তু এতক্ষণ ধরে কোথায় খুঁজছিলি" মা খুবই উদ্বিগ্ন
"মা, ওকে আমি সব জায়গায় খুঁজলাম, পেলাম না। প্রথমে বাজারে গিয়ে সবাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ বলতে পারল না। তারপর রেল লাইনের ধার ধরে অনেকটা দেখে এলাম পেলাম না। একজন বলল আশেপাশের হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিতে, আমি সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে গিয়েছিলাম কিন্তু কোথাও পেলাম না মা, কোথাও পেলাম না", আর অভয় নিজেকে আটকে রাখতে পারল না, মাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। মা, বাবা কারোর মুখে রা নেই। কিই বা বলবে! এই দুঃখের জন্য সান্ত্বনা দেওয়ার কি কোনো ভাষা হয়, হলেও তা তারা পড়ে নি। অভয়ের চোখের জলে মায়ের পিঠের আঁচল ভিজে গেল।
"অভি শান্ত হ। সত্যি কথা বলতে কি আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। যদি কিডন্যাপ হতো তাহলে তো এতক্ষণ কিডন্যাপারদের ফোন আসত। তোর কাছে, তোকে না পেলে আমার কাছে, কারোর কাছে তো ফোন আসতই। বাজারে গিয়ে যদি অসুস্থ হতো বা অন্য কোনো দুর্ঘটনা ঘটত তাহলে তো নিশ্চয়ই খবর পেতাম, তুইও তো হাসপাতালে গিয়েছিলি কোথাও না কোথাও থেকে খবর তো পেতাম। মন শক্ত কর। এখুনি ভেঙে পরলে হবে? সামনে অনেক লড়াই পরে আছে।" অভয়ের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বাবা সান্ত্বনা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করল
মা অভয়কে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসতে বললে অভয় খিদে নেই বলে জানাল। মা-বাবা মিলে খুব জোরাজুরি করাতে অভয় খেতে রাজি হলো।
"তুই হাত মুখ ধুয়ে আয়, আমি ভাত বাড়ছি।"
মাথা নেড়ে অভয় ঘরে ঢুকে গেল।

রাতে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে কিন্তু অভয়ের কিছুতেই ঘুম আসছে না। বারে বারে অপরাজিতার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। গতকাল অপু ফল অফিস থেকে ফেরার সময় ফল নিয়ে আসতে বলেছিল কিন্তু অভয় ভুলে গিয়েছিল। যদি সে এটা না ভুলতে তাহলে আজ অপু ফল আনতে যেত না আর তাকে অভয় হারান না। "উঃ ভগবান কেন যে আমি ভুলে গেলাম!" মনে মনে অভয় নিজেকে দোষ দিতে লাগল। সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না যে অপুর হলোটা কি। কেউ তুলে নিয়ে গেল, নাকি কোনো দুর্ঘটনা ঘটল, নাকি অপু নিজেই..... ধুর এসব কি চিন্তা করছি! অভয় আবার চোখ বন্ধ করল। আবার দশ বছর আগেকার সেই সব ঘটনা তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে----
সম্পর্কের ঘনত্ব এখন অনেকটা বেড়েছে। এমনই একদিন রাতে ফোনে কথা বলতে বলতে মহুয়া অভয়কে জানাল যে সে তাকে একটা মিথ্যা কথা বলেছে। অভয় একটু আশ্চর্য হলো, "কি মিথ্যা বলেছ তুমি?"
"আগে বল তুমি রাগ করবে না" মহুয়া অভয়ের কাছে দাবি করার মতো করে বলল
"রাগ করব কেন? তুমি যখন মিথ্যা কথা বলেছ তখন নিশ্চয়ই এটার প্রয়োজন ছিল। এবার বলে ফেলো তো কথাটা কি।"
"আমার নাম মহুয়া নয়। অপরাজিতা। অপরাজিতা সেন। আর আমি তোমার প্রিয় বন্ধু বিমল মানে ছটকুদার বোন, মাসির মেয়ে।"
"কি! তুমি বিমলের বোন? ওর সাথে তো আমার প্রতিদিন ফোনে কথা হয়, ও আমাকে কিছু বলল না কেন?" অভয় একটু বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল
"দাদাকে আমিই বলতে মানা করেছিলাম তো। তুমি কিন্তু রাগ করবে না বলে আমাকে কথা দিয়েছিলে"
"রাগ তো করিনি, অবাক অবশ্যই হয়েছি। যাইহোক, ব্যাপারটা আমাকে একটু বুঝিয়ে বলো তো"
"শোনো, গতবছর আষাঢ়নবমী পুজোয় আমি মাসির বাড়িতে গিছিলাম। সেখানেই আমি তোমাকে দেখি, মনে হয়েছিল আমি তোমাকে দেখতেই থাকি। আমি তোমাকে ভালোবাসি অভি।"
শেষের কথাটা অভয়ের ভিতর ঝড় তুলে দিল, উত্তেজনায় তার হাত-পা কাঁপতে লাগল। কথিত বলার চেষ্টা করেও মুখ দিয়ে টু শব্দ করতে পারছে না। তার যে ঠিক কিরকম অনুভূতি হচ্ছে তা সে নিজেও জানে না। এরকম অনুভূতি তার আগে কখনো হয়নি। একজন যুবতী নিজে থেকে তাকে প্রেম নিবেদন করেছে এ কথা অভয় নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সে নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। সম্বিত ফিরতেই তার কানে গেল--
কি হলো? কথা বলছ না যে? বুঝেছি, তুমি ভাবছ চেনা নেই, জানা নেই একটা মেয়ে এমন কথা কি করে বলতে পারে, আর একটা অচেনা মেয়েকে কি এইভাবে ভালো বাসা যায়? তাই তো?
"না, মানে" অভয় কিছু বলার চেষ্টা করতেই অপরাজিতা তাকে থামিয়ে দিল, "তুমি তো ঠিকই ভাবছ, এটা ভুল তো নয়। তুমি আমাকে চেনো না, জানো না, এমনকি আমার কোনো ছবিও দেখো নি। এরকম ভাবে কাউকে ভালোবাসা যায় নাকি? আচ্ছা তুমি বাড়ি কবে আসছ?"
"এই তো সামনের মাসেই" জড়ানো গলায় অভয় উত্তর দিল
"এবার যখন বাড়ি আসবে তখন আমরা দেখা করব, ঠিক আছে?"
"অবশ্যই দেখা করব। কিন্তু কোথায় দেখা করব?"
"আমার বাড়ি তো পানাগড়। আমরা তাহলে মাঝামাঝি জায়গায় কোথাও দেখা করব। বর্ধমানে?
"ঠিক আছে, তাই হবে।"
এরপর থেকে প্রতিদিন নিয়ম করে অভয় আর অপরাজিতার ফোনোপ্রেম চলতে থাকে। অর্ধেক রাত পর্যন্ত ফোনাফোনি চলত। ধীরে ধীরে অভয় অপরাজিতার প্রতি দুর্বল হয়ে পরল। তবে এটাকে ঠিক ভালোবাসা বলা যায় না তবে মোহাচ্ছন্নতার থেকে বেশি তো বটেই। আর এইভাবেই সেই দিনটা চলে এলো।
অভয় একটু তাড়াতাড়িই পৌঁছে গিয়েছিল। সে ভিষন উত্তেজিত, যত সময় এগিয়ে আসছে তার উত্তেজনাও ততই বাড়ছে। অপরাজিতার পৌঁছানোর আগে আধ ঘণ্টায় তিনটে সিগারেট খাওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু তাও উত্তেজনা এতোটুকু প্রশমিত হয় নি।
"অভয়?" পিছন থেকে ডাকটা এলো, সেই মিষ্টি আওয়াজ।
দুজনের এই ভালোবাসাকে পরিনতি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়াটা এক নাটকীয় ঘটনা। অপরাজিতার বাবা কালনার এক নামকরা ব্যবসায়ী, অগাধ পয়সা আর প্রতিপত্তি। অভয় মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। সুতরাং এই বিয়ে কি অপরাজিতার পরিবার মেনে নেবে? এছাড়াও অতীতের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার কারনে প্রেম করে বিয়ে করা অপরাজিতার বাবা একদম পছন্দ করে না। এই দুটো কথাই ওদের দুজনের রাতের ঘুম কে রে নেয়। এমতাবস্থায় ত্রাতা হিসেবে এগিয়ে এল বিমল। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিমল অপরাজিতার বাবার কাছে অপরাজিতার সাথে অভয়ের বিয়ের প্রস্তাব রাখে এবং বিমল তার মেসোমশাইকে বোঝায় যে অভয় ছেলে হিসেবে খুবই ভালো আর অপরাজিতার জন্য উপযুক্ত। এইভাবে একটা বিমল একটা 'লাভ ম্যারেজ'কে 'এরেঞ্জ ম্যারেজ'-এ বদলে দিল। অভয়কে তার অনেক বন্ধু ঠাট্টা করে বলত, "তোর কপাল মাইরি! রাজকন্যা আর রাজত্ব দুইই পেলি"
এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। বিবাহিত জীবনের দশটা বছর কেটে গেছে। তারা এখন দুই ছেলেমেয়ের মা-বাবা। এদিকে কচ্ছ থেকে দিল্লি, হরিয়ানা হয়ে গত পাঁচ বছর ধরে অভয় কলকাতায় আছে। বাড়ি থেকে যাতায়াত করে। কিন্তু অপরাজিতার অভয়ের গ্রামের বাড়িতে থাকাটা বা কলকাতায় বদলি হয়ে আসাটা খুব একটা পছন্দ নয়। সে চায় অভয়ের সাথে বাইরে বাইরে ঘুরতে। কিন্তু অভয় তার মা- বাবার একমাত্র ছেলে, বয়স্ক বাবা-মাকে ছেড়ে কি ও বাইরে বাইরে ঘুরতে পারে? এছাড়া তার একটা মাটির টান আছে। সেই টাইন ওকে টেনে নিয়ে এসেছে। এই মাটিতেই তার নাড়ি পোঁতা আছে, এটা তো তার নাড়ির টান। এই টান কি সে উপেক্ষা করতে পারে!

এলার্মটা বাজতেই অভয় ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। জানলা দিয়ে সূর্যের ছটা এসে বিছানায় পরছে। তবে কি বেলা অনেকটা হয়ে গেল? দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল আটটা বাজে। কাল অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারেনি তাই, ক্লান্তও ছিল খুব তাই কখন যে আটটা বেজে গেছে জানতেও পারে নি। চায়ের কাপে চুমুক দিতেই একটা গাড়ির হর্ন কানে এলো। গাড়িটা যেন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। চায়ের কাপটা রেখে অভয় দরজা খুলল, দরজার সামনে অপরাজিতার বাবা অর্থাৎ তার শ্বশুর দাঁড়িয়ে। শ্বশুরমশাইকে অভ্যর্থনা জানিয়ে অভয় আশ্চর্যের সঙ্গে তার শাশুড়ি কেন আসে নি জিজ্ঞাসা করল। শ্বশুরমশাই জানাল যে তার শাশুড়িমাকে তার বোনের বাড়িতে অর্থাৎ বিমলের বাড়িতে রেখে এসেছে। অভয় খুব অবাক হল। বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত তার শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের বাড়িতে এক কাপ চা পর্যন্ত খায় নি। যখনি আসে ওরা বিমলদের বাড়িতেই ওঠে আর আজ এমন বিপদের দিনেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি?
"অভি তাড়াতাড়ি থানায় চলো। রিপোর্টটা লিখিয়ে আমাকে আবার ফিরতে হবে। বিকেলে ব্যবসায়ী সমিতির মিটিং আছে"
কথাটা কানে যেতেই অভয়ের মাথাটা গরম হয়ে গেল, সে চিৎকার করে উঠল, "কি ভেবেছেন কি আপনারা? মনুষ্যত্ব বলে আপনার কি কিছু আছে? অপরাজিতা আপনার মেয়ে, সেটা মাথায় আছে তো নাকি? আপনার কি এতোটুকু মায়া মমতা নেই? এই পরিস্থিতিতে আমি কোনো খাবার মুখে তুলতে পারছি না আর আপনি এইসব মিটিং-মিছিলের কথা বলছেন! ঐ বাচ্ছাদুটোকে দেখুন। ওরা আপনার নাতি-নাতনি, আপনারই রক্ত। কাল থেকে ওরা মা-মা করে কাঁদছে আর আপনি রিপোর্ট লিখিয়েই চলে যাওয়ার কথা বলছেন? যতদিন না অপুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে ততদিন আপনি এখানেই থাকবেন। আমাদের বাড়িতে থাকতে না চাইলে আপনার শালির বাড়িতেই থাকবেন, কিন্তু আপনাকে এখানেই থাকতে হবে" এক নিশ্বাসে অভয় নিজের সব রাগ, দুঃখ, হতাশা তার শ্বশুরের উপর ঢেলে দিল।

থানায় ঢুকে অভয় দেখল এসআই সাহা নেই। এক হাবিলদারকে জিজ্ঞাসা করে অভয় জানতে পারল যে উনি রাউন্ডে গেছেন আসতে দেরি হবে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে অভয় সাহাবাবুর মোবাইলে কল করল, "হ্যালো, স্যার আমি অভয় মানে অভয় মন্ডল বলছি, চিনতে পারছেন"
"হ্যাঁ-হ্যাঁ খুব চিনতে পারছি, বলুন"
"স্যার আমি আমার শ্বশুরমশাইকে নিয়ে এসেছি, এফআইআর করতে। আপনার আসতে কি দেরি হবে?"
"আপনি এক কাজ করুন, আমার টেবিলের ঠিক সামনের দত্তবাবু আছেন ওনার কাছে গিয়ে রিপোর্টটা লিখিয়ে দিন, আমার নাম করে বলুন ওনাকে আমার বলা আছে। তারপর আপনার শ্বশুরমশাইকে ছেড়ে দিয়ে আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।"
"ঠিক আছে স্যার"
রিপোর্ট লিখিয়ে অভয় শ্বশুরমশাইকে বাড়ি ফিরে যেতে বলল। শ্বশুরমশাই চলে গেলে অভয় থানার সামনের চায়ের দোকানে গেল। সকালে টাটা ভালো করে খাওয়া হয় নি, একটা চা আর একটা সিগারেট নিল। অভয়ের মাথায় এক ঝাঁক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, ইনসপেক্টর সাহা কি কোনো সুত্র পেয়েছেন? অপরাজিতাকে কি এবার খুঁজে পাবে সে? আচ্ছা অপু কি কাল রাতে কিছু খেয়েছে? ছেলে-মেয়ে দুটোর চিন্তায় অপু খুব কষ্ট পাচ্ছে। অপুর হলো কি, এই ভাবে উবে গেল কি করে?
এতক্ষণ নিশ্চয়ই ইনসপেক্টর এসে গেছেন। সিগারেটটা ফেলে দিয়ে পা দিয়ে নেভার তারপর দোকানে পয়সা দিয়ে চলে গেল।
"স্যার আসতে পারি?"
"আরে আসুন আসুন। বসুন। চা খাবেন?"
"না স্যার। ধন্যবাদ। আমি এইমাত্র দোকান থেকে খেয়ে এলাম। কোনো খবর পেলেন স্যার?"
"আপনার স্ত্রীর যে নম্বরটা আপনি দিয়েছিলেন তার টাওয়ার লোকেশনের রিপোর্ট আর গত দু'মাসের কল হিস্ট্রি আমি পেয়েছি। লাস্ট টাওয়ার পাওয়া গেছে স্টেশন বাজারের, গতকাল সকাল এগারোটা আঠারো মিনিটে। তারপর থেকেই এই নম্বরটা বন্ধ। আচ্ছা অভয়বাবু যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?"
"মনে করব কেন! আপনি যে কোনো প্রশ্ন করতে পারেন। নিঃসংকোচে জিজ্ঞাসা করুন।"
"আচ্ছা আপনার সাথে আপনার স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন? মানে আমি বলতে চাইছি আপনার স্ত্রীর কি অন্য কোনো এফেয়ার আছে রে কখনো আপনার মনে হয়েছে?"
"কি বলছেন স্যার! এরকম হতেই পারে না।"
"আমি এখুনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না তবে এটা আমার ধারনা। দেখুন ওনার কল হিস্ট্রি যাচাই করে দেখেছি যে একটা নম্বর থেকে আপনার স্ত্রীর কাছে বারবার ফোন আসত আর প্রতিদিন নিয়ম করে তাদের ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হতো। আশ্চর্যের বিষয় নম্বরটা পশ্চিমবঙ্গের নয়। হরিয়ানার।"
"কি বলছেন? এমনও তো হতে পারে যে আমার হরিয়ানায় যখন পোস্টং ছিল তখন সেখানে ওর যাদের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল তাদেরই কেউ?"
"মি. মণ্ডল আপনি কি কখনো আপনার কোনো বন্ধুর সাথে এইভাবে প্রতিদিন নিয়ম করে কয়েক ঘন্টা করে কথা বলতে চাইবেন? তাছাড়া ঐ নম্বরটার টাওয়ার লোকেশন বলছে গত কয়েকদিন ধরে ঐ নম্বর এই রাজ্যেই আছে আর গতকাল নম্বরটার শেষ টাওয়ার লোকেশন পাওয়া গেছে বর্ধমান স্টেশনে, সকাল দশটায়। যাই হোক আপনাকে আর একটা ইনফরমেশন দিই। আপনার স্ত্রীর টিকটক নামের একটা ভিডিও শেয়ারিং সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে একটা একাউন্ট আছে তা কি জানেন?"
"কি বলছেন স্যার! ও ওসব কবে শিখল? অপু তো স্মার্ট ফোন ঠিকঠাক ব্যবহার করতেই জানত না। আমি তো এ ব্যাপারে কিছু জানি না।"
"আপনি অনেক কিছুই হয়তো জানেন না মি. মণ্ডল, ভালো করে খোঁজ নিন, আপনার স্ত্রীর অতীত সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন। যাই হোক আপনি এখন আসতে পারেন। আমি সময় মতো আপনার সাথে যোগাযোগ করে নেব। আর হ্যাঁ আপনার কাছে কোনো তথ্য এলে যেন আমাকে জানাতে ভুলবেন না।"
অভয়ের মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোল না, সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে সে থানা থেকে বেরিয়ে গেল।

বাড়ি পৌঁছে অভয় চুপ চাপ একটা চেয়ারে বসে পরল। মাথায় কিছু ঢুকছে না। অপুর কোনো এফেয়ার থাকতে পারে এটা কিছুতেই সে বিশ্বাস করতে পারবে না। এটা কখনোই হতে পারে না। এইসব ভাবতে ভাবতেই মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করতে লাগল। এমন সময় অভয়ের ছেলে অজয় এসে জিজ্ঞাসা করল, "বাবা, মাকে এনেছ? ঠাম্মা যে বলল তুমি মাকে আনতে গেছ! মা কোথায় বলো না বাবা? মা আসছে না কেন?"
অভয় ভেল ভেল করে তার শিশু পুত্রের দিকে তাকিয়ে রইল। তার কাছে এইসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। সে যে নিজেও এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর খুঁজছে। সেই মুহূর্তে অভয়ের মা এলো, অজয়কে কোলে নিয়ে বলল, বাবা মা খুঁজতে খুঁজতে হাঁপিয়ে গেছে দেখতে পাচ্ছ না সোনা? এখন খেলা কর যাও, মা কে পেয়ে গেলে বাবা ঠিক নিয়ে আসবে। আমার সোনা ছেলে, যাও ও ঘরে।"
অজয় চিৎকার করে উঠল, "নাআআআ। আমার মাকে চাই। এক্ষুনি চাই। আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না।"
ঠাম্মা অজয়কে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে অনেক চেষ্টা করে চুপ করাল। কিছুক্ষণ পরে আবার অভয়ের ঘরে এসে দেখে সে চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছে আর তার চোখ দিয়ে ঝড় ঝড় করে জল পরছে।
কিরে! এইভাবে বাচ্ছা ছেলের মতো চোখের জল ফেললে হবে? একটু শক্ত হ।"
"মা, অজয়ের প্রশ্নগুলো যে আমার কানে গরম তেলের মতো এখনো ঢুকছে। কানের পর্দা যেন ফেটে যাবে মনে হচ্ছে মা। একটা প্রশ্নেরও জবাব আমার কাছে নেই।"
জানি বাবা, আমি তো তোর মা, তোর কষ্টটা আমি বুঝব না। সবই বুঝতে পারছি তবুও বলছি পারলে নিজেকে একটু শক্ত কর। এইভাবে ভেঙে পরিস না।"
"আচ্ছা মা, বাড়িতে অপু সারাদিন কি করত? ওর মধ্যে ইদানীং কি কোনো অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেছিলে?"
মা অভয়ের দিক থেকে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে উত্তর দিল, "ও কি স্বাভাবিক কোনো দিনও ছিল?"
এরপর ঘরে কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল আর তারপর অভয় উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "মা আমি একটু বিমলদের বাড়ি থেকে আসছি" তারপর হনহন করে বেরিয়ে গেল।

দরজায় কলিং বেলের বোতাম টিপে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে উঠল কিন্তু কোনো উত্তর পেল না তাই অধৈর্য হয়ে কয়েকবার দরজা পেটাল। এবার ভিতর থেকে আওয়াজ এলো আর সঙ্গে সঙ্গেই বিমল দরজা খুলল, "কি রে! কি ব্যাপার? এই ভরদুপুরে এখানে?"
"কেন? খুব অসুবিধায় ফেলে দিলাম বুঝি?" বলেই অভয় বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল। ঘরে ঢুকেই অভয় দেখল বিমলের মা, বাবা আর অভয়ের শ্বশুর, শাশুড়ি খেতে বসেছে, সবাই মাংস ভাত খেতে খেতে খোশ মেজাজে গল্প করছে। এই দৃশ্য দেখেই অভয়ের রক্ত গরম হয়ে গেল, যাদের মেয়ে নিরুদ্দেশ তারা এরকম খোশ মেজাজে কি করে থাকতে পারে! অভয়কে দেখেই সকলে অপ্রস্তুতে পরে গেল, কেউই তো এই মুহূর্তে অভয়কে সেখান আশা করে নি। নিজেকে সামলে নিয়ে অভয়ের শাশুড়ি বলল, "এসো বাবা, এসো। কোনো খবর পেলে?"
"কোনো খবর পেলাম কি পেলাম না তা নিয়ে আপনাদের কি কাজ! আপনারা যেমন মাংস ভাত খাচ্ছেন, খান আর ফুর্তি করুন। আমাকে শুধু একটা সত্যি কথা বলুন, আমার আগে অপরাজিতার কি অন্য কোনো সম্পর্ক ছিল? দয়া করে কিছু গোপন করবেন না, সত্যি করে বলবেন।"
"এ কি বলছেন বাবা! এ যে শোনাও পাপ। দোহাই তোমায় আমার মেয়ের চরিত্রে এমন কালো দাগ তুমি দিও না", অভয়ের শাশুড়ি কাঁদতে লাগল।
উঃ, এই নাকে কান্না অভয়ের আর সহ্য হচ্ছে না। কোনো প্রত্যুত্তর না দিয়ে অভয় সেখান থেকে চলে গেল।
আশা, আশঙ্কার দোলাচলে এইভাবে দুটো দিন কেটে গেল। দুপুরে অভয় নিজের ঘরে শুয়ে অতীতের সুখের দিন গুনছিল। অভয়ের বাবা অভয়কে ডেকে জানাল যে বৈশাখী এসেছে, তার জন্য অপেক্ষা করছে। সে গ্রামেরই বছর কুড়ি বাইশের একটি মেয়ে, অজয়কে পড়ায়। অপরাজিতাই ঠিক করেছিল। বৈশাখীর সাথে অভয়ের সরাসরি কোনো দিন কথা হয় নি তাই অভয় ভেবে পাচ্ছে না যে সে আবার কি বলবে। ঘরে ঢুকতেই বৈশাখীর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, "অভয়দা, একটা কথা বলছিলাম। মানে আমার মনে হলো এটা আমার আপনাকে জানানো উচিৎ তাই........"
"অপুর ব্যাপারে?"
"হ্যাঁ, দাদা"
"বলো, বলো। নিঃসঙ্কোচে বলো। প্রতিটা ইনফরমেশন এখন গুরুত্বপূর্ণ।"
"দাদা, কয়েকদিন আগে বৌদির খোঁজ করে আমার কাছে একটা ফোন এসেছিল। হিন্দিতে কথা বলছিল। ভয় পেয়ে আমি ফোন টা কেটে দিয়েছিলাম।"
"কিন্তু তোমার নম্বর তার কাছে গেল কিভাবে?"
"মাস খানেক আগে আমি যখন অজয়কে পড়াচ্ছিলাম তখন বৌদি একবার আমার ফোনটা নিয়ে কাউকে ফোন করেছিল। হয়তো তাকেই। তারপর আবার কল লিস্ট থেকে নম্বরটা ডিলিটও করে দেয়।"
"ঠিক আছে, তুমি আমাকে নম্বরটা দাও"

বৈশাখী চলে যেতেই অভয় ইনসপেক্টর সাহাকে ফোন করল। বৈশাখীর থেকে পাওয়া তথ্য দিয়ে তার থেকে পাওয়া মোবাইল নম্বরটা ইনসপেক্টরকে দিল। ইনসপেক্টর সাহা অভয়কে বলল--
"অভয়বাবু আমার কাছেও কিছু তথ্য আছে। আপার স্ত্রীর কল হিস্ট্রি থেকে পাওয়া নম্বরটা শ্রীভান সিং গুর্জর নামের এক ব্যক্তির, তার বাড়ি হরিয়ানার হিসার জেলায়। মজার কথা হলো এই শ্রীভান নামের এক ব্যক্তি আপনার স্ত্রীর টিকটক গ্রুপেও আছেন। আরও আশ্চর্যের বিষয় ঐ গ্রুপে আপলোড করা ভিডিওগুলোতে আপনার স্ত্রী কিন্তু নিজেকে অবিবাহিতা বলে পরিচয় দিয়েছেন। একটা ভিডিওতে তো আবার আপনার মেয়েকে তাঁর ভাইঝি বলে পরিচয় দিয়েছেন আর কোন ভিডিওতেই ওনার বিবাহের চিহ্ন নেই এমনকি প্রতিটা ভিডিও চ্যাট বা আপলোডেড ভিডিও শুট করার আগে বেশ যত্ন সহকারে সিঁদুর মুছতেন।"
"কি বলছেন স্যার! আমি তো ভাবতেই পারছি না।"
"আপনাকে তো বলেছিলাম, আপনি অনেক কিছুই জানেন না। ঠিক আছে রাখছি।"
ফোনটা রেখে অভয় ধপ করে বসে পরল। তার মাথার ভেতরটা কেমন যেন খালি খালি মনে হচ্ছে। চারিদিক শূণ্য মনে হচ্ছে। সে যেন এক অতল গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে।

বিকালে এসআই সাহার ফোন এলো। থানার নম্বর দেখে অভয়ের মনে একটু আশার আলো খেলল, হয়তো কোন খবর আছে। তবে কি অপরাজিতার খবর পাওয়া গেছে! এসব সাত-পাঁচ চিন্তা করতে করতে তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করল-
"হ্যালো!"
"অভয়বাবু, আমি ইনসপেক্টর সাহা বলছি।"
"বলুন স্যার। নতুন কোনো খবর আছে? অপরাজিতার কি খোঁজ পাওয়া গিয়েছে?"
"তা ধরুন পাওয়া গিয়েছে। তবে ফোনে সব বলা যাবে না। আর তাছাড়া তদন্তের কাজ এখনো একটু বাকি আছে। আপনি এক কাজ করুন, আজ সন্ধ্যা সাতটায় আপনার শ্বশুরমশাই আর শাশুড়িমা কে নিয়ে থানায় চলে আসুন। আর হ্যাঁ, আপনার বন্ধু বিমলকেও সঙ্গে আনবেন। এখন আমি রাখছি।"
অভয় আশা-আশঙ্কায় বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ইনসপেক্টর কি এমন খবর পেলেন যে এদের সবাই কে নিয়ে যেতে বললেন। তাহলে কি সত্যিই অপুর কারোর সাথে সম্পর্ক আছে? না-না, কি যা তা চিন্তা মাথায় আসছে! এটা হতেই পারে না। অপু আমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালো ভাসতে পারে না। চিন্তায় চিন্তায় জর্জরিত অভয় চোখ বন্ধ করে উপরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, "হে ঈশ্বর, আমাকে এ কোন পরীক্ষার সামনে ফেললে তুমি!"

সন্ধ্যা ঠিক পৌনে সাতটায় ওরা থানায় পৌঁছে গেল। অভয়ের আর তর সইছে না, তাই একটু আগেই পৌঁছে গেছে কিন্তু ইনসপেক্টর সাহা কোথায়? ওনাকে তো দেখা যাচ্ছে না! অভয় কাউকে জিজ্ঞাসা করে সময় নষ্ট করতে চাইল না তাই সরাসরি সাহাবাবুকেই ফোন করল। ইনসপেক্টর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলল। বাইরে আছে, ফিরছে। মিনিট কুড়ি-পঁচিশ সময় লাগবে। আরও আধ ঘন্টা! অভয়ের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর থানার বাইরে এসে পায়চারি করতে লাগল।
"কি ব্যাপার অভয়বাবু এখানে ঘুরছেন কেন? ভিতরে চলুন", গাড়ি থেকে নেমে এসআই সাহা জিজ্ঞাসা করল
"স্যার আপনি এসেছেন! আমার একেবারেই তর সইছে না। আপনি প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি সব বলুন। আগে বলুন আমার অপু কোথায় আছে, ও ভালো আছে তো?" কাতর হয়ে অভয় বলল
ইনসপেক্টর গোঁফের কোলে একবার মুচকি হেসে বলল, "ভিতরে চলুন, সব বলছি।"
ভিতরে গিয়ে অভয় আর ইনসপেক্টর নির্দিষ্ট চেয়ারের বসল। এক গ্লাস জল খেয়ে ইনসপেক্টর সাহা বলতে শুরু করল--
"অভয়বাবু আপনি আজ দুপুরে আমাকে যে নম্বরটা দিয়েছিলেন তার ইতিহাস-ভূগোল আমি খুঁজে বের করেছি। সেটাও হরিয়ানার নম্বর আর ঐ শ্রীভান সিং গুর্জরেরই।"
এই কথা শোনা মাত্র অভয়ের শ্বশুর-শাশুড়ি পরস্পরের দিকে তাকাল।
ইনসপেক্টর আবার বলতে শুরু করল, "ঘটনার দিনে ঐ নম্বরটার টাওয়ার লোকেশন বলছে সকাল এগারোটার সময় স্টেশন বাজারে ছিল, একটার সময় হাওড়া স্টেশনে ছিল। দুপুর তিনটের দিকে কলকাতা এয়ারপোর্ট তারপর আড়াই ঘণ্টা বন্ধ, অন হয় দিল্লি এয়ারপোর্টে। আমি এখানকার স্টেশন ও হাওড়া স্টেশনের সিসি টিভি ক্যামেরার ফুটেজ চেক করে দেখে বুঝেছি যে আপনার স্ত্রী স্বেচ্ছায় গেছেন।"
"কি বলছেন স্যার! আমি তো এসব কথা ভাবতেও পারছি না!" অভয়ের বাকরুদ্ধ হওয়ার মতো অবস্থা।
"অভয় বাবু, অবাক করার মতো আরও অনেক ঘটনা আছে। ওনার টিকটক গ্রুপে ব্যারাকপুরের এক বিহারি ছেলে আছে। তাকে জেরা করে জানতে পেরেছি যে ওই গ্রুপের সদস্যরা জানে আপনার স্ত্রী অবিবাহিতা ও শ্রীভানের প্রেমিকা। এবং আজ সকালে ওদের দুজনের রেজিস্ট্রি করে বিয়েও হয়ে গেছে।"
"কি? বিয়ে! অপু আবার বিয়ে করেছে? ও ছেলে মেয়ে দুটোর কথা একবারও ভাবল না!" অভয়ের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল
এদিকে তার শ্বশুর-শাশুড়ি আর বিমল মাথা নিচু করে বসে আছে।
ইনসপেক্টর একবার ওদের দিকে তাকিয়ে দেখল তারপর আবার বলতে শুরু করল, "আপনার শ্বশুরমশাই, শাশুড়িমা আর আপনার এই বাল্য বন্ধুটি কিন্তু আগে থেকে সব জানতেন।"
এটা শুনেই অভয় চমকে উঠল, "কি বলছেন ইন্সপেক্টর!"
"একদম ঠিক শুনেছেন আপনি আর আমিও ঠিকই বলেছি। আপনি নিজেই জিজ্ঞাসা করুন না।"
"বাবা! মা! বিমল! ইনসপেক্টর যা বলছেন তা কি সত্যি?
ওরা মাথা নিচু করে বসে রইল। কেউ কোনো কথা বলল না। অভয় আবার চেঁচিয়ে উঠল, "চুপ করে আছেন কেন বাবা? বলুন।"
এসআই সাহা বলল, "আরে ওরা কি বলবে, আমি বলছি শুনুন। সেদিন আপনি থানা থেকে যাওয়ার পর আপনার বন্ধু তার মেসোমশাই কে জানান যে আপনি থানায় এসেছিলেন আর কেসটা আমি দেখছি।"
"বিমল এই বুঝি তোর ইম্পর্টেন্ট কাজ?" অবজ্ঞার সুরে অভয় বলল।
"এই খবর পেয়ে আপনার শ্বশুরমশাই তাঁর পলিটিক্যাল সোর্স ও পাওয়ার কাজে লাগিয়ে আমার উপর প্রেসার দেওয়ান যাতে আমি এই কেসটা কোনো তদন্ত না করে ধামা চাপা দিই। আগেও যেমন করেছেন আর কি" ইনসপেক্টর আবার বলল।
অভয় চমকে উঠে বলল, "আগেও করেছেন মানে?"
"সেটাও বলছি। অভয়বাবু, আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম না যে আপার স্ত্রীর আগে কারোর সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল কি না? তাহলে শুনুন, আপনার স্ত্রী এর আগে দুবার দুজন আলাদা আলাদা ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়েছিলেন। একজনের নাম অমিত রায় আর একজনের নাম আনোয়ার হোসেন।"
কি! এতো বড় কথা আপনারা চেপে গিয়েছিলেন? আমি সেদিনও জিজ্ঞাসা করলাম, এতো করে বললাম সত্যি কথাটা বলতে আর আপনারা নির্দ্বিধায় এরকম নাটক করে গেলেন! আপনারা কি মানুষ? ছিঃ ছিঃ!"
ওরা তিন জনেই মাথা নিচু করে রইল। তদের তো কিছু বলার থাকতেও পারে না।
"আরও চমকে দেবার মতো কথা শুনুন। অভয়বাবু আপনার বন্ধু মধ্যস্থতা করে আপনাদের প্রেমের সম্পর্ককে এরেঞ্জ ম্যারেজের রূপ দিয়েছিলেন, তাই তো?"
"হ্যাঁ, একেবারেই তাই।"
"না, একেবারেই ভুল। এটাও একটা নাটক। আরও পরিস্কার করে বললে একটা বিরাট ষড়যন্ত্র। আপনার স্ত্রীর যা রেকর্ড ছিল তার জন্য ওর বিয়ে দেওয়া মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। তখন আপনার শ্বশুর-শাশুড়ি বিমলবাবুকে বলেন যে উনি যদি বিয়ের ব্যবস্থা করিয়ে দেন তাহলে মোটা উপঢৌকন দেবেন। বলতে দ্বিধা নেই যে বিমলবাবু মোটা উপঢৌকন পেয়েওছিলেন। কি বিমলবাবু তাই তো?"
বিমল নিরুত্তর। এখনো মাথা নিচু করেই বসে আছে।
"ওঃ! তাই যাদের দু'বেলা দু'মুঠো খাবার জুটতো না আমার বিয়ের পরেই দেখলাম তাদের দু'তলা পাকা বাড়ি হয়ে গেল, নতুন বাইক চলে এলো! আমার জীবনের তুই এইভাবে সওদা করলি! বিমল, তুই এতো নীচ! আমি তোর ছোটো বেলার বন্ধু আর তুই আমার এতো বড় সর্বনাশ করলি?"
"অভয়বাবু, আপনি চাইলে আপনাকে ঠকানো, আপনাকে ডিভোর্স না দিয়ে আবার বিয়ে করা ইত্যাদি অপরাধের জন্য আপনার স্ত্রীর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন। যদি বলেন তো আমি কেস রুজু করতে পারি" এসআই অভয়কে বলল।
জবাবে অভয় বলল, "দেখুন ইনসপেক্টর, আমি ওই কলঙ্কিনিকে তো আর ঘরে তুলব না। ও যেমন আছে থাক। আমার সামনে এখন বিরাট দায়িত্ব। ওসব আইনি জটিলতায় যাওয়ার আমার কোনো ইচ্ছা নেই।"
"অ্যাজ ইউ উইস" ইন্সপেক্টরের ঠোঁটে হালকা হাসির ঝলক। মনে মনে ভাবল একেই বোধহয় ভালোবাসা বলে। অভয়ের শ্বশুরের দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল, "নিন এটাতে একটা সই করে দিন"
"এটা কি অফিসার?" অভয়ের শ্বশুর জিজ্ঞাসা করল
"এটা একটা এফিডেভিট, এতে লেখা আছে যে আপনার মেয়ে স্বেচ্ছায় অভয় বাবুকে ছেড়ে গেছেন, এই ঘটনার জন্য অভয়বাবু কোনো ভাবেই দায়ী নন, ভবিষ্যতে আপনারা কোনো অভয়বাবুর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনতে পারবেন না।" এসআই জবাব দিল।
"অফিসার, আমার জামাই হীরের টুকরো, ওর কোনো তুলনা হয় না। আমার মেয়ে ওর সাথে সংসার করার যোগ্য নয়। আমি ওর সাথে অনেক অন্যায় করেছি, ওর জীবনটাই নষ্ট করে দিয়েছি। আবার ওর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ কি কখনো করতে পারি? আর কত পাপ করব। দিন কাগজটা আমি সই করে দিচ্ছি।"

ঝোড়ো কাকের মতো অবস্থায় অভয় বাড়ি ঢুকল। ওর বাবা-মা দুজনেই উৎসুক হয়ে বসেছিল। বাড়ি ঢুকতেই বাবা জিজ্ঞাসা করল, "কি রে, কোনো খবর পেলি?"
"বলছি বাবা। মা, এক গ্লাস জল দাও তো।" কোনো রকমে কথা গুলো বলে ঘরের মেঝেতে বসে পরল। মা জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিতেই এক নিশ্বাসে অভয় জলটা খেয়ে নিল। তার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল।
"কি রে অভি, বল কি খবর পেলি" মা অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল। অভয় সব কথা তার মা বাবাকে বলল, আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। বিলাপ করতে করতে সে তার মা-বাবার উদ্দেশ্যে বলল, "আমি তো ভাবতেই পারছি না যে অপু অন্য কারোর সাথে পালিয়েছে। আমাকে ছেড়ে গিয়ে সে অন্য কাউকে বিয়ে করেছে মা! আমার কথা না হয় ছেড়েই দাও ওর কি অজয়-অর্পিতার জন্যও এতোটুকু মায়া হো না? ও পারবে এদের ছেড়ে থাকতে?"
অভয়ের মা বাবার কাছে এর কোনো উত্তর নেই। ওরা ভেবে পাচ্ছে না যে কোন ভাষায় সান্তনা দেবে?
সবাই চুপ, ঘরে এখন নিস্তব্ধতা, যেন শ্মশানের শান্তি। নিজেকে সামলে নিয়ে অভয় তার মা কে জিজ্ঞাসা করল, "মা অজয় আর অর্পিতা কোথায়?" মা বলল পাশের ঘরে আছে।
পাশের ঘরে গিয়ে অভয় যে দৃশ্য দেখল তা ওকে যেন চাবুকের মতো আঘাত করল। এই দৃশ্য যতটাই করুন ততটাই মর্মান্তিক আর ততটাই হৃদয়স্পর্শী। দেখল ছোট্ট অর্পিতার কোলে অজয় শুয়ে শুয়ে কাঁদছে মাকে চাই বলে আর অর্পিতা তার দাদার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে আদো আদো গলায় বলছে, "কাঁদিস না দাদা, মা নেই তো কি হয়েছে? আমি তো আছি। আমি তোকে ঘুম পাড়িয়ে দেব।"
এই দৃশ্য অভয়কে নাড়িয়ে দিল। সে মনে মনে অপরাজিতার উদ্দেশ্যে বলল, "দেখো, দেখো। এই পাঁচ বছরের শিশুটারও মনে মমতার উদ্রেক হয়েছে তা তোমার ভিতরে নেই। নাহ্, তুমি নারী নও, নারীরূপী কোনো মায়াবীনি।

সৈনিক

সৈনিক           উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী   ছেলেটা গত কালই বাড়ি ফিরেছিল, ছ'মাস পর, মাঝে ছুটি পায়নি সে। ফুলসজ্জার পরের দিন চলে যেতে হয়েছ...