পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

বাম-কং জোট ও কিছু কথা

বাম-কং জোট ও কিছু কথা
                         উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী

ভারতবর্ষের রাজনীতিতে বামপন্থীরা ও কংগ্রেসীরা যেন দুই মেরুর বাসিন্দা। নীতি ও আদর্শগত ভাবে এদের একে অপরের থেকে কয়েক যোজন দূরে অবস্থান। কিন্তু এতো বৈষম্য সত্ত্বেও আজকের দিনে এই দুই রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী এক ছাতার তলায় এসে দাঁড়িয়েছে, বলা ভালো পরিবর্তিত পরিস্থিতি এদের এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। মজার বিষয় হলো স্বাধীনতার আগে বামপন্থীরা অনেক ক্ষেত্রেই কংগ্রেসের ভিতরে থেকেই কাজ করতেন, তবে স্বাধীনতার আগের কংগ্রেস আর পরের কংগ্রেসের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। যাই হোক, বর্তমান রাজনীতির আকাশে এহেন বাম-কং জোট নিয়ে বহু বিতর্কও আছে। হার্ডকোর বামপন্থীরা বা হার্ডকোর কংগ্রেসীরা এই জোট মেনে নিতে পারেন নি, সেই সাথে তৃতীয়ত পক্ষের কটাক্ষ তো আছেই। আমি এই তৃতীয়ত পক্ষ নামক 'বস্তু'টিকে কোনো গুরুত্বই দিচ্ছি না। আমার এই লেখা সেই সমস্ত হার্ডকোর বাম ও কং সমর্থকদের উদ্দেশ্যে যারা এই জোটকে মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না।

ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত কেউ সপ্নেও বামফ্রন্ট আর কংগ্রেসকে এক (রাজনৈতিক) মঞ্চে দেখে নি। কিন্তু সম্পর্কের এই শীতলতা ক্রমশ কমতে শুরু করে প্রথম ইউপিএ সরকারের সময় থেকে। এর প্রধান কারণ ভারতবর্ষে ফ্যাসিবাদী-সাম্প্রদায়ীক শক্তির উত্থান। সাম্প্রদায়িকতা বা ফ্যাসিবাদ যেকোন সভ্যতার পক্ষেই বিপজ্জনক। কারণ এই মতবাদ মানুষের মনুষ্যত্বকেই নষ্ট করে দেয়। ফলে মানুষ নরখাদকে পরিনত হয়। সুতরাং কোনো দেশ বা সভ্যতার সবচেয়ে বড় শত্রু হলো ফ্যাসিবাদী বা সাম্প্রদায়ীক সংগঠন (রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক)।

"শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু", নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু এই তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন, তাই ব্রিটিশদের পরাস্ত করার জন্য সেই সময়ের কুখ্যাত দুই রাষ্ট্রনেতা জোসেফ স্ট্যালিন ও অ্যাডফ হিটলারের হাত ধরতেও প্রস্তুত ছিলেন। এটাই হওয়া উচিৎ। সবার আগে দেশ ও জনগণের স্বার্থ তারপর সবকিছু। আমার দেশটাই যদি না থাকে তাহলে আমার রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে কি ধুয়ে জল খাবো?

অনেক বাম সমর্থক আছেন যাঁরা হয়তো অতীতে কংগ্রেসের দ্বারা কোনো ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আবার অনেক কংগ্রেস সমর্থক আছেন যাঁরা বামফ্রন্টের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আর তাই তাদের একে অপরের প্রতি ব্যাক্তিগত আক্রোশ থাকতেই পারে, থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাকে ভেবে দেখতে হবে যে আমার কাছে কোনটা বড়, আমার ব্যাক্তিগত আবেগ নাকি দেশের স্বার্থ। এ ব্যপারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো আমেরিকা আর জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার পারমাণবিক বোমার আঘাতে পুরো জাপান তছনছ হয়ে গিয়েছিল। এমনকি এখনো জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে অনেক বিকলাঙ্গ শিশু জন্মায়। এর থেকে বড় ক্ষতি কি কেউ কারোর করতে পারে? না পারে না, কিন্তু বর্তমানে এই দুটি দেশ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কারণ একটাই, চীন। জাপান নিজের দেশের স্বার্থে আমেরিকার হাত ধরেছে। এটা যদি সম্ভব হয় তবে দেশের স্বার্থে বাম ও কং সমর্থকরা একে অপরের হাত কেন ধরতে পারবে না?

নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ফ্যাসিবাদী সরকারগুলোর মধ্যে অন্যতম। এরা জনগণের প্রতি নূন্যতম দায়বদ্ধতা দেখায় না তাই কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হয় না। গত প্রায় সাত বছরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদী একটাও সাংবাদিক সম্মেলন করেন নি। দেশের প্রায় সমস্ত মিডিয়া হাউসকে 'সাম-দাম- দন্ড-ভেদ' এই নীতিতে কুক্ষিগত করে রেখেছেন, ফলে তারাও সরকারকে প্রশ্ন করার বদলে তাদের গুণগান গাইতেই ব্যাস্ত। এটাই হলো ফ্যাসিবাদ নামক রোগের প্রধান উপসর্গ। সরকারকে প্রশ্ন করলেই তাকে দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমার আপনার রান্না ঘরে কি রান্না হবে, ফ্রিজে কিসের মাংস থাকবে তাও নাকি এরাই ঠিক করে দেবে! দেশের এই পরিস্থিতি অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। আজ যখন আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুড অয়েল জলের দরে বিক্রি হচ্ছে তখন দেশে পেট্রোপন্নের দাম আকাশ ছোঁয়া, সেঞ্চুরির দুয়ারে দাঁড়িয়ে, কোথাও কোথাও যদিও সেঞ্চুরি হয়ে গেছে। আর এর স্বপক্ষে বিজেপি নেতাদের যুক্তি - "দেশের স্বার্থে এই মূল্যবৃদ্ধি, সরকার এতো উন্নয়ন করছে (?) তার জন্য টাকা চাই তো।" কি অদ্ভুত যুক্তি, তাই না? টাকা যদি চাই তবে স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকারের দ্বারা নির্মিত এতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি কেন করছে, মূলত দুজন ব্যাবসায়ী, আধানি আর আম্বানিকে। সেটাও নাকি দেশের স্বার্থে। কিভাবে? কেউ জানে না। কেন্দ্র সরকার কৃষি আইন সংশোধন করে কৃষকের পেটে লাথি মেরে ঐ আধানি আর আম্বানির পেট ভরাচ্ছে। দেশের জিডিপি মাইনাসে চলে যাচ্ছে কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর জন্য আট হাজার কোটি টাকার ফ্লাইট আসছে বিদেশ থেকে। সেটার নাকি তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপার। তাহলে দেশের জওয়ানদের নিরাপত্তা নেই কেন? কেন পুলওয়ামার মতো ঘটনা ঘটে? না, আপনি উত্তর পাবেন না তবে দেশদ্রোহীর তকমা পেতে পারেন।

বাংলাও এই একই রকম এক ফ্যাসিস্ট, দুর্নীতিবাজ, তুঘলকি সরকারের খপ্পরে পরেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাওয়াই চটি পরে সৎ সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর ওনার দলের নেতা মন্ত্রীরা ফুলে ফেঁপে উঠছে। চিটফান্ডের মাধ্যমে গরীব মানুষের রক্ত জল করা কোটি কোটি টাকা ওনার দলের নেতারা হজম করে বসে আছে। ওনার ভাইপো এক 'রাজ প্রাসাদ' বানিয়েছে, টাকা কোথা থেকে এলো? প্রশ্ন করবেন না, তাহলেই আপনি 'মাওবাদী' হয়ে যাবেন। গত দশ বছরে রাজ্যে সে অর্থে একটাও সরকারি নিয়োগ হয়নি। যতগুলো এসএসসি হয়েছে সবগুলো দুর্নীতির অভিযোগে বিচারাধীন। তৃণমূলের নেতা মন্ত্রীদের বাড়ির কুকুর বেড়ালও চাকরি পাচ্ছে কিন্তু জনগণের চাকরি নেই। শিল্প তো স্বপ্নেও আসে নি।

এগুলো তো খুব মামুলি ব্যাপার, মোদী ও দিদির সরকারের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হল নৈতিকতার অভাব। গত সাত বছরে বিজেপি যত গুলো রাজ্যের ক্ষমতায় এসেছে তার ৯০% ভোটে হেরেও টাকার বলে ক্ষমতা দখল করেছে। এই একই পথের পথিক তৃণমূলও। গত দশ বছরে তৃণমূলও টাকার লোভ দেখিয়ে বা মিথ্যা মামলা দিয়ে একের পর এক বিরোধীদের হাতে থাকা গ্রাম পঞ্চায়েত বা পুরসভা দখল করেছে। এই সংস্কৃতি বাংলার রাজনীতিতে বিরলতম। কথায় বলে কাক কাকের মাংস খায় না কিন্তু কংগ্রেসের সাথে জোটে থাকাকালীনও তৃণমূল কংগ্রেসে এমএলএ, এমপি থেকে নেতা কর্মী সমর্থকদের ভাঙিয়ে নিয়ে গিয়ে কংগ্রেসকে দুর্বল করেছে। বামফ্রন্ট কিন্তু শত বিরোধীতা থাকলেও কংগ্রেসের সাথে কখনোই এই ঘৃণ্য রাজনীতি করেনি। এই রাজনৈতিক মাফিয়াগিরি দুর করতে বাম'-কং জোট চাই।

আজকের দিনে তৃণমূল বাংলার রাজনৈতিক আবহাওয়াকে চরম কলুষিত করেছে। এখন তাদের সাথে জুটেছে বিজেপি। এখন রাজনৈতিক বক্তৃতায় পুলিশকে বোম মারতে বলা হয়, বিরোধীদের খুন করার কথা বলা হয়, বদলার কথা বলা হয়, ধর্ষনের হুমকি দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলা রাজনীতি এতো নোংরা ছিল না। বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস শত বিরোধীতা সত্ত্বেও সর্বদাই সৌজন্যতা ও নৈতিকতার বার্তা বহন করেছে। কমঃ প্রমথ দাশগুপ্ত মারা যাওয়ার পর তাঁর স্মরণে আয়োজিত বামফ্রন্টে ব্রিগেড সমাবেশে বক্তৃতা করেছিলেন প্রয়াত কংগ্রেস নেতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী। তেমনই বামফ্রন্ট সরকারের দ্বারা নির্মিত বিধান নগরের নাম রাখা হয়েছিল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা বিধান রায়ের নামে। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে এমন সৌজন্যের উদাহরণ বহু পাওয়া যাবে। দেশের রাজনীতিতেও এমন সৌজন্যতা ভুরি ভুরি আছে। কিন্তু বর্তমানে বিজেপি ও তার বি-টিম তৃণমূলের জন্য এই সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ যেন স্বপ্ন। আমাদের এই সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশটা ফিরিয়ে আনতে হবে। তার জন্য বাম-কং জোট সফল করতে হবে।

ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে দেশের স্বার্থে সেই সময়কার কংগ্রেসী আর বামপন্থীরা হাতে হাত রেখে এক সাথে লড়াই করেছে এখন আমাদের প্রজন্মের পালা। তাই বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস সমর্থকদের কাছে আমার অনুরোধ চলুন আমরা সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে দেশের শত্রু, রাজ্যের শত্রু ফ্যাসিবাদী, দুর্নীতিবাজ, নীতিহীন মোদী ও মমতার হাত থেকে দেশ তথা রাজ্যকে উদ্ধার করতে আবার একসাথে হাতে হাত রেখে লড়াই করি।

সৈনিক

সৈনিক           উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী   ছেলেটা গত কালই বাড়ি ফিরেছিল, ছ'মাস পর, মাঝে ছুটি পায়নি সে। ফুলসজ্জার পরের দিন চলে যেতে হয়েছ...