পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২২

বঙ্গাব্দের সূচনা করেন কে- রাজা শশাঙ্ক নাকি সম্রাট আকবর? - বিতর্কের নিষ্পত্তি!

বঙ্গাব্দের সূচনা করেন কে- রাজা শশাঙ্ক নাকি সম্রাট আকবর? - বিতর্কের নিষ্পত্তি!
                           উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী


বঙ্গাব্দের সূচনা বিষয়টি একটি বিতর্কিত বিষয় কারণ কেউ কেউ বলেন বঙ্গাব্দ গণনা শুরু করেছিলেন বাংলার রাজা শশাঙ্ক আবার কেউ কেউ বলেন আকবর এর শুরু করেছিলেন। বিভিন্ন ইতিহাসবিদ এ নিয়ে তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন। প্রত্যেকের যুক্তিই প্রায় অকাট্য।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক কিংশুক চ্যাটার্জি বিবিসি বাংলাকে বলেন, "শশাঙ্কর আমলে তো বাংলা ভাষাটাই চালু হয়নি। কাজেই তিনি বাংলার জন্য আলাদা অব্দ বা সাল চালু করেছিলেন এটা ভাবাটা বেশ বাড়াবাড়ি। বরং ইতিহাসে আমাদের বলে, মুঘল বাদশাহ আকবর বাংলা জয় করার পর এখানে একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলেন। তারা যখন দেখলেন বাংলা থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য একটা ক্যালেন্ডার দরকার, আর সেটাকে হিন্দু শকাব্দর সঙ্গে সংযুক্ত না করে বরং মুসলিম হিজরীর সঙ্গে কানেক্ট করেই ক্যালিব্রেট করা যাক। খুব সম্ভবত সেভাবেই আকবরের দূতরা বঙ্গাব্দ চালু করে গিয়েছিলেন।"

কিন্তু আকবর তো বাংলা দখল করেন ১৫৭৬-য়ে রাজমহলের যুদ্ধ জিতে তার আগে বাংলায় কোনো বর্ষ গণনা পদ্ধতি চালু ছিল না তা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

যাঁরা বলেন যে শশাঙ্কই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক তাঁদের একটি যুক্তি, শশাঙ্কের মোটামুটি ভাবে ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রাজত্ব করেন বলে ধারণা করা হয়। আবার খ্রীষ্টাব্দের সাথে বঙ্গাব্দের পার্থক্য ৫৯৩ বছর, অর্থাৎ বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয় ৫৯৩ খ্রীষ্টাব্দে। ইতিহাসবিদদের মতে জুলীয় বর্ষপঞ্জির বৃহস্পতিবার ১৮ মার্চ ৫৯৪ এবং গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির শনিবার ২০ মার্চ ৫৯৪ বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল। সুতরাং বঙ্গাব্দের সূচনা যে শশাঙ্কের রাজত্বকালেই শুরু হয়েছিল সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।

তবে এটাও ঐতিহাসিক ভাবে প্রমানিত যে বাংলা দখলের পর আকবর অনুভব করলেন যে হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে এখানে কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে কারন হিজরী পঞ্জিকা চান্দ্র মাসের উপর নির্ভরশীল। চান্দ্র মাস অর্থাৎ চাঁদ পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষীণ করতে যে সময় নেয় (২৯.৫৩ দিন)। এই হিসেবে এক বছর হয় ৩৫৪ দিনে। কিন্তু সূর্য মাস ধরে বছর হয় ৩৬৫ দিনে। ঋতু পরিবর্তনও হয় সূর্যের সাপেক্ষে পৃথিবীর অবস্থানের উপর ভিত্তি করে এখানে চাঁদের কোন ভূমিকা নেই। আর চাষ আবাদ তো ঋতুর ভিত্তিতেই হয়। তাই সম্রাট আকবর বাংলার জন্য একটি সৌর পঞ্জিকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাই আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে হিজরী চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকে সৌর বর্ষপঞ্জিতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ফতুল্লাহ শিরাজীর সুপারিশে পারস্যে  প্রচলিত ফার্সি বর্ষপঞ্জির অনুকরণে ৯৯২ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর নতুন বর্ষপঞ্জি ‘তারিখ-ই-ইলাহী’ বা ‘ইলাহী সন’ চালু করেন। তবে তিনি ঊনত্রিশ বছর পূর্বে তার সিংহাসন আরোহণের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এজন্য ৯৬৩ হিজরী সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ হিজরী সালের মুহররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস, এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান এবং ভারতীয় শিক্ষাবিদ নিতীশ সেনগুপ্তের মতে বাংলা বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি পরিষ্কার নয়। এই উৎপত্তিতে ইসলামী প্রভাব ও বৌদ্ধ বা হিন্দু প্রভাব দুইই থাকতে পারে।

শামসুজ্জামান খান বলেন, “একে বাংলা সন বা সাল বলা হয়। এই সন ও সাল হল যথাক্রমে আরবী ও ফারসী শব্দ। এটা নির্দেশ করছে এগুলো মুসলিম রাজা বা সুলতান কর্তৃক বাংলায় পরিচিত করানো হয়”। অন্যদিকে নিতীশ সেনগুপ্ত বলেন, এর ঐতিহ্যগত নামটি হল বঙ্গাব্দ। আকবরের সময় এই বর্ষপঞ্জিকে বলা হত তারিখ-ই-ইলাহি। বর্ষপঞ্জির তারিখ-ই-ইলাহি ভারশনে, প্রতিটি দিন এবং মাসের আলাদা আলাদা নাম ছিল, আর এখন যে মাসের নামগুলো দেখা যাচ্ছে তারিখ-ই-ইলাহিতে এরকম মাসের নামের বদলে অন্য মাসের নাম ছিল।

আকবরের সময়ের অনেক শতক আগে নির্মিত দুটি শিব মন্দিরে বঙ্গাব্দ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। আর এটাই নির্দেশ করে, আকবরের সময়ের আরও অনেক আগেও বাংলা বর্ষপঞ্জির অস্তিত্ব ছিল।

ইতিহাসবিদরা একে অপরের যুক্তি খণ্ডন করার পরিবর্তে যদি একে অপরের যুক্তিগুলো গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করেন তবেই এই বিতর্কের অবসান হয়ে একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে।

বিভিন্ন ইতিহাসবিদ তথা শিক্ষাবিদের লেখা পড়ে ও তাঁদের যুক্তি ও তথ্য বিশ্লেষণ করে বঙ্গাব্দের সূচনা সম্পর্কে আমার যে ধারনা তৈরী হয়েছে তা হলো, রাজা শশাঙ্কের আমল থেকেই বঙ্গাব্দের গণনা শুরু হয়েছিল তবে পরবর্তীকালে বাংলায় আকবর প্রেরিত কমিটি খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য তাতে কিছু অদল-বদল করে বঙ্গাব্দের পুনর্বিন্যাস করেন, যা আজও চলছে।

সুতরাং বঙ্গাব্দের কৃতিত্ব শশাঙ্ক ও আকবর উভয়কেই দেওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি।

তথ্যসূত্র: গুগল, উইকিপিডিয়া, বিবিসি বাংলা

সৈনিক

সৈনিক           উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী   ছেলেটা গত কালই বাড়ি ফিরেছিল, ছ'মাস পর, মাঝে ছুটি পায়নি সে। ফুলসজ্জার পরের দিন চলে যেতে হয়েছ...