পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ১ জুলাই, ২০২১

প্রযুক্তিগত বেকারত্ব : মানুষের জন্য প্রযুক্তি নাকি প্রযুক্তির জন্য মানুষ?

প্রযুক্তিগত বেকারত্ব : মানুষের জন্য প্রযুক্তি নাকি প্রযুক্তির জন্য মানুষ? 

উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী 


আমাদের সময়ে মাধ্যমিকে বাংলা পরীক্ষায় প্রবন্ধ রচনার একটা খুব সাধারণ বিষয় ছিল 'বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ'। কম বেশি আমরা প্রত্যেকেই এই বিষয়ের উপর রচনা লিখেছি। সেই রচনা লিখতে গিয়ে পরমাণু বিস্ফোড়নের মতো বিজ্ঞানের কিছু কালো দিক যেমন তুলে ধরতাম তেমনই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানব জীবনকে কতটা সহজ করে দিয়েছে তা প্রমাণ করার একটা আপ্রাণ চেষ্টাও থাকত। কারণ আমাদের সেটাই শেখানো হতো। এর বাইরে কিছু ভাবার তেমন অবকাশ বোধহয় আমাদের কারোর তেমন ছিল না। চলুন ছোটবেলায় এই বিষয়ে না ভাবার প্রসঙ্গ গুলোর মধ্যে একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ নিয়ে আজ আলোচনা করি। প্রসঙ্গটা হল- প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার কিভাবে মানুষের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সংকুচিত করে দিচ্ছে এক কথায় প্রযুক্তিগত বেকারত্ব এবং এর ফল কি হতে পারে তা নিয়েও আলোচনা করবো। 

"প্রযুক্তিগত বেকারত্ব" শব্দটি 1930-এর দশকে জন মেইনার্ড কেইন জনপ্রিয় করেছিলেন। প্রযুক্তি ছাড়া মানব জীবন অচল একথা সত্য। মানুষ যেদিন আগুন জ্বালাতে শিখেছে সেদিন থেকেই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এরপর ধীরে ধীরে চাকা আবিষ্কার হয়েছে, ধাতব অস্ত্র আবিষ্কার হয়েছে, মানুষ ঘর-বাড়ি বানাতে শিখেছে, বিভিন্ন যন্ত্র থেকে যানবাহন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে মানুষ আজকেই এই তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবের যুগে এসে পৌঁছেছে। মানুষ নিজের সুবিধার্থে প্রযুক্তিকে প্রতিনিয়ত ব্যাবহার করে এসেছে। প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার যেমন এই গ্রহের আবহাওয়া-জলবায়ু, বাস্তুতন্ত্র তথা সামগ্রিক পরিবেশের ক্ষতি করেছে তেমনই ধীরে ধীরে মানুষের সামনে হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছিল সামগ্রিকভাবে মানবসমাজের উপকারের জন্য এবং একটা সময় পর্যন্ত প্রযুক্তি মানুষের বন্ধুই ছিল কিন্তু কম্পিউটার আবিষ্কারের পর থেকে সম্পর্কের এই সমীকরণটা বদলাতে থাকে। একটা কম্পিউটার একটা নির্দিষ্ট সময়ে একসাথে অনেক মানুষের কাজ করে দিতে সক্ষম এবং এর পিছনে খরচও প্রায় নগণ্য, ফলে উৎপাদন ক্ষেত্র সহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের বদলে কম্পিউটার ব্যবহারের প্রবণতা বাড়তে থাকে ফলে ধীরে ধীরে কর্ম সংস্থানের সুযোগ কম থাকে। বিভিন্ন সময় এর বিরুদ্ধ প্রতিবাদ হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন নেতা ও সংগঠন (বিশেষত বামপন্থী সংগঠনগুলো) এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। সত্তরের দশকের শুরুতে ভারতবর্ষে প্রথম কম্পিউটারের আগমন হয়। এই দশকের শেষে ও আশির দশকের শুরুতে ভারত সরকার ব্যাঙ্কিং সেক্টরে কম্পিউটা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে এই ক্ষেত্রে অন্তত ২৩% কর্মসংস্থান হ্রাস হবার পরিস্থিতি তৈরী হয় যার বিরুদ্ধে বিভিন্ন বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি আন্দোলনে নামে, তৎকালীন জনতা দলও ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন, "আমি কম্পিউটারের বিরুদ্ধে নই, আমি সেই কম্পিউটারের বিরোধী যে মানুষের অন্ন কেড়ে নেয়।" তবে আশির দশকেই প্রথম নয়, প্রযুক্তিগত বেকারত্ব তার আগেও ছিল। লেখক গ্রেগরি ওরোলের মতে, প্রযুক্তিগত বেকারত্বের ঘটনাটি অন্তত চাকা আবিষ্কার হওয়ার পর থেকেই সম্ভবত বিদ্যমান ছিল। রোমান সম্রাট ভেস্পাসিয়ান তাঁর পারিষদদের কতৃক প্রস্তাবিত ভারী পণ্যের স্বল্প ব্যয়ে পরিবহনের একটি নতুন পদ্ধতিকে অনুমোদন দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, "আপনাদের অবশ্যই আমার দরিদ্র পরিবহন শ্রমিকদের রুটি উপার্জন করতে দিতে হবে।" ষোড়শ শতকের শেষে ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথ উইলিয়াম লি কে তাঁর আবিষ্কৃত সেলাই মেশিনের পেটেন্ট দিতে অস্বীকার করেন এবং বলেন, "একবার ভেবে দেখেছেন আপনার এই আবিষ্কার আমার গরীব প্রজাদের কতো ক্ষতি করবে? প্রজাদের রোজগার কেড়ে নিয়ে তাদের ভিক্ষুক বানিয়ে ছাড়বে।" 

এই কম্পিউটারের আরও আধুনিক রূপ হলো রোবট, যা মানুষের জন্য আরও ঘাতক হয়ে দেখা দিয়েছে। আমরা যেমন আজকাল শুনছি যে করোনা ভাইরাস জিনগত অভিযোজন করে নিজেকে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে ঠিক তেমনই কম্পিউটার অভিযোজিত হয়ে রোবটের রূপ নিয়েছে যা মানুষের ভবিষ্যতকে আরও ভয়াবহ করে তুলবে। গত ১৬ই জানুয়ারি 'টাইমস অব ইন্ডিয়া'-তে প্রকাশিত একটা প্রতিবেদন অনুযায়ী তথ্যপ্রযুক্তির শিল্পে রোবট ব্যাবহারের কারণে ২০২২ সালের মধ্যে ঐ শিল্পে অন্তত ৩০ লক্ষ কর্মী ছাঁটাই হবে (পড়ুন) এর ফলে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলো দশ হাজার কোটি ডলার অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করবে। এক একটি রোবট সাতজন দক্ষ কর্মীর কাজ করতে পারে বলে খবরে বলা হয়েছে। এই তথ্যটা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিচ্ছে। এই প্রসঙ্গে গান্ধীজি বলেছিলেন, "আমি যন্ত্রের বিরোধী নই তবে যন্ত্র ব্যাবহারের পাগলামির বিরোধী। এই পাগলামির জন্য একসময় হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে, মানুষ না খেতে পেয়ে মরে রাস্তায় পরে থাকবে।" গান্ধীয়ান অর্থনীতিতে বলা হয়েছে যে যতদিন না বেকারত্ব সমস্যার সমাধান হয় ততদিন শ্রম সাশ্রয় মেশিন ব্যাবহারে আপত্তি জানায়। যদিও নেহরু এই মতকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেন। 

একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তিগত বেকারত্ব বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, অক্সফোর্ড অধ্যাপক কার্ল বেনেডিক্ট ফ্রে এবং মাইকেল ওসবার্ন অনুমান করেছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 47 শতাংশ চাকরি স্বয়ংক্রিয়তার জন্য ঝুঁকিতে রয়েছে (👉এই বইটির পিডিএফ কিনতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন)। ২০১৭ ২০১৩ সালে ওয়্যার্ড পত্রিকার (Wired (Magazine)) একটি প্রতিবেদন (পড়ুন) অর্থনীতিবিদ জিন স্পার্লিং এবং পরিচালনা অধ্যাপক অ্যান্ড্রু ম্যাকাফি হিসাবে জ্ঞানীদের উদ্ধৃত করে লিখেছে যে স্বয়ংক্রিয়তার ব্যবহারের ফলে বর্তমান ও আসন্ন কর্মসংস্থানের যে ক্ষতি হবে তা সামলানো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে চলেছে। প্রযুক্তিগত বেকারত্বের ফলাফল অতি মারাত্মক হতে চলেছে। প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে মালিক পক্ষ যেমন বহুগুণ মুনাফা কামাচ্ছে তেমন শ্রমজীব মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। এক দিকে একদল মানুষ যখন নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে অপর দিকে গুটিকয়েক ব্যাবসায়ীর সম্পত্তি দিন দিন ফুলে ফেঁপে উঠছে। ফলে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যটা প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে দেখা দিচ্ছে। ভারতের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ মানুষ এ দেশের জাতীয় সম্পদের ৭৭ শতাংশের অধিকারী (পড়ুন)। এই একটি তথ্যই ভারতবর্ষের অর্থনীতিকে নগ্ন করে দেয়। এই ভাবে চলতে থাকলে, ধৈর্য্যের বাঁধ একবার ভেঙ্গে গেলে এক সময় না কর্মহীন ক্ষুধার্ত কোটি কোটি মানুষ ক্ষোভে, দুঃখে, পেটের জ্বালায় মরিয়া হয়ে কয়েকশো কোটিপতি ব্যাবসায়ীকে আক্রমণ করবে। শুরু হবে এক ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধ, যা সামলানো কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভব হবে না।

এই ভয়ঙ্কর পরিনতি থেকে বাঁচতে দেশ, ভৌগলিক সীমা ভুলে সারা বিশ্বের নেতৃত্বকে এখনই এগিয়ে আসতে হবে। প্রযুক্তি অবশ্যই দরকার কিন্তু যদি মানুষ নাই বাঁচে তাহলে প্রযুক্তি নিয়ে হবে কি? তাই প্রযুক্তির ব্যবহার ও কর্মসংস্থানের সুযোগ এই দায়ের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যেন একজন ব্যবসায়ী মুনাফার সবটা নিয়ে চলে না যায়। সরকারকে আইন করে কোনো সংস্থার বার্ষিক লেনদেন ও ঐ সংস্থাতে কর্মরত শ্রমিক বা কর্মচারীদের একটা অনুপাত নির্দিষ্ট করে দিতে হবে তবে যদি এই সমস্যার কিছুটা অন্তত সুরাহা হয়। 

তথ্যসূত্র: গুগল, উইকিপিডিয়া

সৈনিক

সৈনিক           উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী   ছেলেটা গত কালই বাড়ি ফিরেছিল, ছ'মাস পর, মাঝে ছুটি পায়নি সে। ফুলসজ্জার পরের দিন চলে যেতে হয়েছ...