পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ১২ জুন, ২০২০

বামপন্থা ও আন্দোলন, বিদ্রোহ তথা বিপ্লবের ব্যাখ্যা এবং এর পিছনে বামপন্থী মতাদর্শের ভূমিকা

বামপন্থা ও আন্দোলন, বিদ্রোহ তথা বিপ্লবের ব্যাখ্যা এবং এর পিছনে বামপন্থী মতাদর্শের ভূমিকা
                   উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী 


আন্দোলন আনে বিদ্রোহ বা বিপ্লব যা সুনেতৃত্বের দ্বারা সংগঠিত হয়ে অভ্যুত্থানের রূপ নেয়। সুতরাং এটা বোঝা যাচ্ছে যে কোনো অভ্যুত্থানই একদিন সংগঠিত হয় না। ক্রমাগত রাষ্ট্র তথা শাসকের বঞ্চনা, অবহেলা ও অত্যাচার জনগণের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে কিন্তু রাষ্ট্রের ভয় জনগণকে প্রতিবাদ করতে দেয় না। কিন্তু ভয় আর কতদিন? তারও একটা সীমা আছে। যেদিন ভয় তার চরম সীমায় পৌঁছয় সেদিন সে ক্ষোভ বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর অনুঘটকের কাজ করে এবং ক্রমে তা সাহসে রূপান্তরিত হয়। এর ফলে শুরু হয় ছোটো ছোটো প্রতিবাদী আন্দোলন। তখন রাষ্ট্র সাধারণত দুটো অবস্থান নেয়; এক, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেখিয়ে সেই প্রতিবাদী আন্দোলনগুলোকে উপেক্ষা করা অথবা দুই, ভয় পেয়ে প্রতিবাদীদের উপর সীমাহীন অত্যাচার বর্ষণ করা যা আমরা ৪ জুন, ১৯৮৯এ চীনের রাজধানী বেইজিং শহরের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে দেখেছি। এই ঘটনা ইতিহাসে তিয়েনআনমেন স্কয়ার গণহত্যা বা ৪ জুন গণহত্যা নামে কুখ্যাত।

    তিয়েনআনমেন স্কয়ারে, ৪ জুন, ১৯৮৯

বামপন্থা ছাড়া কখনোই বা কোনো কালেই কোনো আন্দোলন সংগঠিত হয় নি, হতে পারে না। এই কথা শুনেই দক্ষিণপন্থীরা রে-রে করে তেড়ে আসতেই পারেন। কিন্তু এটাই বাস্তব। কেন এটা বাস্তব তা বোঝার জন্য আগে বামপন্থা কি সেটা জানতে হবে। বেশির ভাগ (ডানপন্থী) মানুষ বামপন্থা বলতেই বোঝেন মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন ইত্যাদি। কিন্তু তাদের এই ধারনা সর্বৈব ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন। তাঁদের মতবাদগুলো বামপন্থার অংশ ঠিকই কিন্তু বামপন্থা মানেই তাঁদের মতবাদ নয়। রাজনীতিতে বামপন্থা ও দক্ষিণপন্থা ধারণার উদ্ভাবন হয় ফরাসি বিপ্লবের সময় (১৭৮৯-৯৯)। সেই সময় ফরাসী এস্টেট জেনারেলে বাম দিকের চেয়ারগুলোতে যাঁরা বসতেন তাঁরা সাধারণত রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করতেন এবং প্রজাতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা তৈরি সহ বিপ্লবকে সমর্থন করতেন। আর যারা ডান দিকে বসতেন তাঁরা পুরনো ও প্রচলিত শাসনব্যবস্থা ও তার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের সমর্থক ছিলেন। ১৮১৫ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাপী রাজনীতিতে 'বাম' শব্দের ব্যবহার ব্যাপক হয়। অর্থাৎ ধর্মীয় বা রাজনৈতিক মতাদর্শে যাঁদের গোঁড়ামি নেই এবং যারা প্রচলিত বস্তাপচা ধ্যানধারণার পরিবর্তনপন্থী তাদের "বামপন্থী" বলা হয়। সমাজবাদ, সাম্যবাদ তথা কমিউনিজম (পূর্ণ সাম্য) ইত্যাদি আদর্শ ও মতবাদ গুলো বামপন্থী রাজনীতির ধারক ও বাহক। তবে প্রতিটি মতবাদেরই সময়ের সাথে জনস্বার্থে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আবশ্যক।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত ইংরেজি সাপ্তাহিক 'ফরওয়ার্ড ব্লক'-এর ৫ই আগস্ট, ১৯৩৯এর সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন-
"'তত্ত্ব' ও 'বিপরীত তত্ত্ব'-র সমন্বয়ে 'সমন্বয় তত্ত্ব'-র জন্ম হয়। এই 'সমন্বয় তত্ত্ব' আবার ক্রমবিকাশের পরবর্তী পর্যায়ে 'তত্ত্ব' হয়ে ওঠে। এই 'তত্ত্ব' আবার 'বিপরীত তত্ত্ব' কে জাগিয়ে তোলে। এবং সেই সংঘর্ষের সমাপ্তি ঘটে আবার এক সমন্বয় তত্ত্ব'-এ। এইভাবে প্রগতির চাকা ক্রমাগত এগিয়ে চলে।"


'তত্ত্ব' ও 'বিপরীত তত্ত্ব'-র উদ্ভাবন ও তার থেকে 'সমন্বয় তত্ত্ব'-র জন্মের এই প্রক্রিয়াকেই 'বামপন্থী কার্যক্রম' বলে তিনি বর্ণনা করেছেন। আন্দোলন, বিদ্রোহ বা বিপ্লব অথবা অভ্যুত্থান তখনই হয় যখন মানুষ প্রচলিত 'তত্ত্ব' থেকে বিমুখ হয়ে 'বিপরীত তত্ত্ব'-র খোঁজে নামে। এটা একটু পরিস্কার করে বোঝাতে আমরা চীনের উদাহরণ দিতে পারি। তৎকালীন প্রচলিত রাজতন্ত্র নামক 'তত্ত্ব'-র বিরুদ্ধে একটি 'বিপরীত তত্ত্ব'-র খোঁজে শুরু হয় আন্দোলন। সেখান থেকে 'বিপরীত তত্ত্ব' হিসেবে উঠে আসে 'একদলীয় শাসনব্যবস্থা' সময়ের সাথে সাথে যা 'সমন্বয় তত্ত্ব' হয়ে বর্তমানে 'তত্ত্ব'-র রূপ নিয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন সময়ে এই তত্ত্বর বিপরীত তত্ত্ব হিসাবে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ছোটো ছোটো প্রতিবাদী আন্দোলন হচ্ছে। এই সমস্ত প্রতিবাদী আন্দোলনকে যারা সমর্থন করবে তারাই বামপন্থী বলে গণ্য হবে আর যারা বর্তমানে প্রচলিত একদলীয় শাসনব্যবস্থাকেই চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে তাদের চিন্তাধারা অবশ্যই দক্ষিণপন্থী।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সমাজে প্রচলিত জাত-পাতের ভেদাভেদ ভুলে সকলকে সমান চোখে দেখার কথা প্রচার করেছিলেন। তিনিই ভারতের প্রথম 'সাম্যবাদ'-এর প্রবর্তক। তাঁর নেতৃত্বে ঘটা সামাজিক আন্দোলনও 'বামপন্থী আন্দোলন' বলেই গণ্য হয়।

রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় চলতে থাক প্রতিবাদী আন্দোলনগুলো সাধারণত ধারাবাহিক কর্মসূচির মধ্যে পরে। এইসব আন্দোলন গুলোর পিছনের কারনও ভিন্ন হয় কিন্তু এগুলোর প্রতিক্রিয়া হয় একই আর তা হলো জনমনে বারুদের সঞ্চার। প্রতিবাদের এই বারুদে যখন রাষ্ট্রের উপেক্ষা বা অত্যাচারের স্ফুলিঙ্গ পরে তখন সেই আন্দোলন সংগঠিত হয় ফলে জনগণ সেই শাসক তথা সরকার বা 'রাষ্ট্রনেতা' বা ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে যে সমস্ত কর্মসূচি গ্রহণ করে তাকে বিদ্রোহ বা বিপ্লব বলে আর এই বিপ্লবের একটা বৃহত্তর রূপ হলো 'অভ্যুত্থান'। যদিও বিদ্রোহ ও বিপ্লবের মধ্যে কিছুটা গুণগত পার্থক্য আছে। বিপ্লব বিদ্রোহের আর এক নাম হলেও বিদ্রোহ বিপ্লবের সমার্থক নয়। ব্যাপার একটু বুঝিয়ে বলা যাক, যে সংগঠিত আন্দোলন রাষ্ট্রের শাসক তো পরিবর্তন করে দেয় কিন্তু শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন করে না বা করতে পারে না তাকে বলা হয় বিদ্রোহ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় জিম্বাবুয়ে ও রবার্ট মুগাবের কথা। 
  জিম্বাবুয়ের সালিসবারি শহরে রবার্ট মুগাবে, এপ্রিল,    ১৯৮০

আফ্রিকার একটি ছোটো দেশ রোডেশিয়ার স্বৈরাচারী ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে সে দেশের জনমানসে পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে পাথেও করে রবার্ট মুগাবে এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলন সংগঠিত করে জয়ী হন। তাঁর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় 'রিপাবলিক অব জিম্বাবুয়ে'। সমগ্র আফ্রিকায় তিনি নায়কের সম্মান পেতেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই মুগাবেই পরিণত হয়েছিলেন স্বৈরাচারী শাসকে। সীমাহীন দুর্নীতি ও ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে একসময়কার সমৃদ্ধশালী জিম্বাবুয়েকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছিলেন তিনি। অর্থাৎ তাঁর আন্দোলনে শাসকের মুখ পরিবর্তন হলো ঠিকই কিন্তু শাসনব্যবস্থা ও নীতি তথা শাসকের চরিত্রে বদল হলো না। তাই তাঁর দ্বারা সংগঠিত এই আন্দোলনকে বিপ্লব নয় বরং বিদ্রোহ বলা যায়। অপরদিকে যদি আমরা ফরাসি বিপ্লব ও ভিয়েতনাম বিপ্লবের দিকে দেখি সেখানে দেখব মানুষের সংগঠিত আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে সম্পূর্ণ নতুন শাসনব্যবস্থার পত্তন ঘটায়। অর্থাৎ এই আন্দোলনগুলোর ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে যায় তাই এগুলো হলো 'বিপ্লব'। সুতরাং সংক্ষেপে বলা যায়, যে আন্দোলনের উদ্দেশ্য শুধুই ক্ষমতার হস্তান্তর তাকে আমরা 'বিদ্রোহ' বলি এবং যে আন্দোলনের উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি করা সেই আন্দোলনকে আমরা 'বিপ্লব' বলি।

    ভিয়েতনাম

কয়েকটি আন্দোলন সংগঠিত হয়ে বিদ্রোহ, বিপ্লব থেকে অভ্যুত্থানে পৌঁছানোর এই সমগ্র প্রক্রিয়া সাফল্যের জন্য যেটা সবথেকে আবশ্যিক তা হলো সু-নেতৃত্ব। দক্ষ নেতা ও তার নির্ভুল রণনীতিই কোনো আন্দোলনকে সংগঠিত করতে ও তার সাফল্য এনে দিতে পারে। আর এর জন্য আবশ্যক সংগ্রামী সৈনিকদের নেতৃত্বে প্রতি অটল বিশ্বাস। তা নাহলে যেকোনো আন্দোলন হয় অঙ্কুরেই বিনাশ হয় অথবা মাঝ পথেই দিশাহীন হয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। যেমনি হয়েছিল নকশালবাড়ি আন্দোলনের ক্ষেত্রে। 

    নকশালবাড়ির আন্দোলনের একটি ছবি, ১৯৬৯(?)

উত্তরবঙ্গের নকশালবাড়ি গ্রামের কৃষকদের উপর ভূস্বামীদের অত্যাচারের ফলে সৃষ্টি জনরোষকে চারু মজুমদারের সু-নেতৃত্ব ও সুশীতল রায়চৌধুরী, কানু সান্যাল ও জঙ্গল সাঁওতালদের নির্ভীক আপোসহীন ব্যক্তিত্ব সংগঠিত রূপ দেয় যা 'নকশালবাড়ি আন্দোলন' (১৯৬৯-৭১) নামে সারা বিশ্বে পরিচিতি পায়। কিন্তু এর পরেই পরবর্তী সময়ে নেতৃত্ব অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং তা থেকে সৃষ্ট অবিশ্বাস ও বিভাজন এবং সবশেষে চারু মজুমদারের গ্রেফতারী ও রহস্য মৃত্যুর ফলে সেই আন্দোলন সু-নেতার অভাবে দিশাহীন হয়ে পরে। দিশাহীন নকশালবাড়ি আন্দোলন লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আজকের দেশ ও দেশবাসীর শত্রু 'মাওবাদী জঙ্গি'তে রূপান্তরিত হয়েছে। চীনের বর্তমান শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দাবিতে মাঝে মধ্যেই যে সব ছোটোখাটো আন্দোলন হয় সেগুলো সু-নেতার অভাবে রাষ্ট্রের দমননীতির মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয় ও অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়।

   নকশালবাড়িতে এক সভায় চারু মজুমদার, ১৯৬৭

বর্তমান সময়ে সারা বিশ্ব তোলপাড় করছে আমেরিকার 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার' আন্দোলনে। কিন্তু এই এই আন্দোলন এক দিনেই হয় নি। আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের উপর শ্বেতাঙ্গদের বর্বর অত্যাচার আজ নতুন নয়। কলম্বাসের আমেরিকার ভূখণ্ডে পা দেওয়ার পর থেকেই এই বর্বরতা চলে আসছে, তাই অনেকেই কলম্বাসকে ঔপনিবেশিকতা ও ক্রীতদাস প্রথার পথপ্রদর্শক হিসেবে ঘৃণার চোখে দেখেন। ওয়াশিংটন পোস্টের একটা সমীক্ষা অনুযায়ী, আমেরিকায় প্রতি বছর এক হাজারের বেশি ও প্রতিদিন অন্তত এক জন কৃষ্ণাঙ্গের মৃত্যু হয় পুলিশের গুলিতে। সুতরাং মানুষের মনে ক্ষোভ ছিলই।
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমেরিকার সানফোর্ডে ট্রেভর মার্টিন নামের এর ১৭ বছরের কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরকে জর্জ জিমারম্যান নামক এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশকর্মী অন্যায় ভাবে গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু সানফোর্ড পুলিশ প্রথমে তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয় নি। পরে জনরোষের চাপে পুলিশ জিমারম্যানকে হেফাজতে নেই কিন্তু তার বিরুদ্ধে গঠিত চার্জ এতোই দুর্বল ছিল যে সে খুনের দায় থেকে মুক্তি পেয়ে যায়। এর পর সে তার 'বীরত্বের নিদর্শন' ঐ বন্দুকটা নিলামে তোলে যা আড়াই লক্ষ ডলারে বিক্রি হয়। এই অমানবিক ঘটনার পরেই 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার' আন্দোলন শুরু হয়। তবে তা বিচ্ছিন্ন ভাবে চলত। এর পরেও মাইকেল ব্রাউন, এরিক গার্নার ইত্যাদি কৃষ্ণাঙ্গরা শ্বেতাঙ্গ পুলিশের দ্বারা খুন হয় আর প্রতিটা ঘটনার পরেই মানুষ কৃষ্ণাঙ্গদের বাঁচার অধিকার নিয়ে গর্জে ওঠে।

    'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার' আন্দোলনের একটি ছবি

সম্প্রতি আমেরিকার অতিমারি পরিস্থিতির পর্যালোচনামূলক একটা রিপোর্ট প্রকাশ হয়। যে রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গরাই এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। আমেরিকার জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ যার মধ্যে ৪৪ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন, ২২ শতাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং ২৩ শতাংশ মানুষের করোনা আক্রান্তের মৃত্যু হয়েছে। এই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসতেই দেশ মানুষের মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা তৈরী হয় যে পুলিশ-প্রশাসন থেকে করোনা প্রতিক্ষেত্রেই কৃষ্ণাঙ্গদেরই ভুগতে হয়। আর ঠিক এই সময়েই জর্জ ফ্লয়েডের নৃশংস খুনের ঘটনা সামনে আসে যা মানুষের মনে জমে থাকা ক্ষোভের বারুদে স্ফুলিঙ্গের মতো কাজ করে। শুরু হয় বৃহত্তর আন্দোলন। এই আন্দোলন এতোটাই সংগঠিত যা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সে দেশে ঘটে যাওয়া শ্রমিক আন্দোলনের কথা মনে করায়। এই আন্দোলন ভালো নেতা ও সুপরিকল্পিত রণনীতির দ্বারা পরিচালিত হওয়া ছাড়া সম্ভব নয়। যদিও এখনো নির্দিষ্ট কোনো নেতা বা সংগঠনের নাম এখনো সামনে আসে নি কিন্তু সরকারি রিপোর্ট বলছে এর পিছনে আমেরিকার বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলো এর পিছনে আছে, রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ANTIFA নামক একটি বামপন্থী সংগঠনের দিকে আঙুল তুলেছেন। মানুষের জমায়েতে লালপতাকার উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি প্রমান করে যে এই আন্দোলন বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।

সবশেষে, বামপন্থীরাই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের রাষ্ট্রীয় শোষনের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে শেখাতে পারে। 

উপসংহার: প্রতিটা আন্দোলন, বিদ্রোহ তথা বিপ্লবের পিছনে থাকে বামপন্থী মতাদর্শের অনুপ্রেরণা। বামপন্থাই মানুষকে মুক্তির পথ দেখায়।

মঙ্গলবার, ২ জুন, ২০২০

প্রতিশোধ

প্রতিশোধ
উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী

          অঙ্কণ : তন্দ্রা ব্রহ্মচারী


শীতটা সবে পরতে শুরু করেছে। বিকেল বেলায় পাঁচটার পর মাথা শিশিরে ভিজে যাচ্ছে। ভোরের দিকেও বেশ ঠান্ডা। এই সময় সকাল বেলায় কাঁথা চাপা দিয়ে ঘুমাতে খুব ভালো লাগে। খাটের পাশে টেবিলে রাখা মোবাইল ফোনটা বাজতে বাজতে ক্লান্ত হয়ে গেল কিন্তু অভিরূপের ঘুম ভাঙল না। ঘন্টা দুয়েক আগে মোবাইলে যখন ঘুম ভাঙানোর বাজনা বেজেছিল তখন অভি চোখ বন্ধ করেই আঙুলের এক খোঁচায় তাকে চুপ করিয়ে দিয়েছিল। এই শান্তির ঘুম ভাঙতে সে মোটেই রাজি নয়। কিন্তু সব সময় যেটা চাওয়া হয় সেটা পাওয়া যায় না। অভির ক্ষেত্রেও তাই হলো। কেউ খুব জোরে জোরে কলিং বেলটা বাজাচ্ছে। অভি ভিশন বিরক্ত হয়ে কানে বালিশ চাপা দিল। মিনিট খানেকের শান্তির পর এবার দরজা পেটানোর আওয়াজ। এবার অভির বিরক্তির বাঁধ ভাঙল। মুখ থেকে বালিশটা সরিয়ে কোনো রকমে চোখটা খুলে ঘড়িটা দেখল, "সাতটা চল্লিশ বেজে গেছে!" অভি তড়াক করে লাফিয়ে খাট থেকে নেমে প্রায় দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল-
"স্যার আপনি?" দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে গোয়েন্দা অফিসার ইনসপেক্টর সনাতন মিত্র।
"তোমার নাম অভিরূপ না হয়ে কুম্ভকর্ণ হওয়া উচিত ছিল। চার বার ফোন করেছি, বার কয়েক ডোর-বেল বাজিয়েছি তাতেও তোমার ঘুম ভাঙল না!" সনাতনের মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট
"না, মানে, স্যার........." অভি আমতা আমতা করতে লাগল।
"বেশ-বেশ, বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে না ভিতরে আসতে বলবে?"
"আরে স্যার, কি যে বলেন! আসুন-আসুন"
সনাতন ঘরের ভিতরে ঢুকে চারিদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল, "মাত্র দু'দিন হলো মালিনী বাপের বাড়ি গেছে এর মধ্যেই তুমি ঘরের যা অবস্থা করেছো! এতো অগোছালো কেউ কি করে হতে পারে অভি?"
"মালিনীও আমাকে একই প্রশ্ন করে। আমিও স্যার এটা ভেবে পাই না", নিষ্পাপ শিশুর মতো মুখ করে অভি জবাব দিল
"হুম, বুঝেছি, তুমি শোধরাবে না। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও, আমাদের বেরোতে হবে।"
"স্যার, নতুন কোনো কেস?"
"সেটা আমি এখনই বলতে পারব না। ডিআইজি সাহেব ডেকে পাঠিয়েছেন, গেলেই বোঝা যাবে।"
"মনে হচ্ছে আমার ভোরের সপ্ন সত্যি হবে। আজ আমি একটা দারুণ সপ্ন দেখেছি স্যার।"
ঠিক আছে, আগে তুমি তৈরী হয়ে নাও, তোমার স্বপ্ন আমি গাড়িতে শুনব।"

আবাসন থেকে গাড়িটা বেরিয়ে বড় রাস্তায় পরতেই সনাতন একটা সিগারেট ধরাল, কয়েকটা টান দিয়ে সিটে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে বলল, "তা ভোর বেলায় কি স্বপ্ন দেখলে অভি যেটা নাকি সত্যি হলে তুমি খুব খুশি হবে?"
"স্যার, দারুন সপ্ন। তবে প্লটটা বছর পঁচিশ পরের।"
"বাবা! টাইম মেশিন নাকি? তা বেশ, এবার ভনিতা না করে বলো তো।"
"স্যার, দেখলাম এক বিরাট ব্যবসায়ী ও তার ছেলেকে একটা ভাইরাস প্রয়োগ করে খুন করা হয়েছে যা একেবারে নর্মাল মৃত্যু মনে হচ্ছে আর সেই কেসটা আপনি সলভ করলেন।" পুরো স্বপ্নটা অভি বিস্তারিত জানাল
"এ তো দেখছি জৈবাস্ত্র হে। হা হা হা....."
"হ্যাঁ স্যার, একেবারেই তাই। আর আশ্চর্যের বিষয় ঠিক এ ভাবেই ডিআইজি স্যার আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন আর আপনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন।"
"তা তোমার সপ্নেও কি তুমি এরকম কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোচ্ছিলে নাকি?"
"কি যে বলেন স্যার.....!" লাজুক মুখটা অভি নামিয়ে নিল
"অভি ভারতে প্রথম জৈবাস্ত্র প্রয়োগের ঘটনা কবে ঘটেছিল জানা আছে?"
"না, স্যার, তা তো বলতে পারব না" জিজ্ঞাস্য চোখে অভি বলল।
"আরে নিজেদের ইতিহাস নিয়ে একটু পড়াশোনা করো। কলেজ স্ট্রিটে লালবাজারের ইতিহাস নিয়ে অনেক বই পাবে, একটু পড়ো, নিজেদের জানো।"
"অবশ্যই পড়ব। স্যার, ওটা কবে হয়েছিল?"
"১৯৩৫ সালে, এই বাংলাতেই। প্লেগের জীবাণু প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়। বীরভূমের এক অভিজাত পরিবারের ঘটনা।"
"কি সাঙ্ঘাতিক!" অভির চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে গেল

"মে আই কামিন স্যার?" সনাতন ডিআইজি সত্যসাধন মুখোপাধ্যায়ের কেবিনে ঢোকার অনুমতি চাইল
"এসো সন্তু, এসো। বসো" সামনে রাখা চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে ডিআইজি বলল
চেয়ারে বসে মুখে একটা প্রশান্তির হাসি নিয়ে সনাতন বলল, "বাবা-মায়ের দেওয়া এই নামটা আপনিই বাঁচিয়ে রেখেছেন স্যার"
মুচকি হেসে অভি বলল, "স্যার দেখবেন এই নামেই একদিন আপনি বিখ্যাত হবেন। ডিটেকটিভ সন্তু।"
"বেশ-বেশ, তুমি বোসো। স্যার এবার বলুন জরুরী তলবের কি কারন।"
ডিআইজি এতক্ষণ কাঁচের ডিম্বাকৃতি পেপার ওয়েটটা টেবিলের উপর হাত দিয়ে লাট্টুর মতো ঘোরাচ্ছিল। মনোবিদরা বলে কেউ যখন গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকে তখন এই ধরনের অভিব্যক্তি তাদের মধ্যে দেখা যায়। সনাতন তাকে জরুরী তলব করার কারণ জিজ্ঞাসা করতেই ডিআইজি হটাৎ করে ঘুরন্ত পেপার ওয়েটটা হাত দিয়ে চেপে ধরল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পর টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়া মাথাটা উপরে তুলল। কপালে বলিরেখা স্পষ্ট। চশমাটা কপালের উপর তুলে বলল, "সন্তু, একটা ব্যাপারে আমি খুব চিন্তিত, ইন ফ্যাক্ট আমার উপর ভিষন প্রেসারও আছে।"
"কি ব্যাপার স্যার বলুন না" সনাতনকে এখন খুব উৎসাহি দেখাচ্ছে কারন ডিআইজি এইভাবে তলব করে যে কেসেরই দায়ীত্ব দিয়েছে প্রতিটা ভিষন চ্যালেঞ্জিং আর সনাতন নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে খুব পছন্দ করে।
"তুমি কি শুনেছ গত পরশু ডানকুনির কাছে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ের পাশের ঝোপ থেকে এক বিদেশী মহিলার লাশ উদ্ধার হয়েছে?"
"হ্যাঁ স্যার, জানি। শুনেছি খুব নৃশংস ভাবে খুন করা হয়েছে?"
"হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ। দুটো স্তন কেটে নিয়েছে, তারপর মুখ থেঁতলে খুন করা হয়েছে। ঘটনাচক্রে এই মহিলা নিউজিল্যান্ড এমব্যাসিতে কর্মরতা তাই আমার উপর কতটা প্রেসার আছে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ?"
"স্যার মহিলাটিকে কি রেপ করা হয়েছিল?"
"আপাত ভাবে তো রেপড্ বলে মনে হয়নি, বাকিটা বোঝা যাবে ফরেন্সিক রিপোর্ট এলে। তুমি এখুনি এই কেসের চার্জ নাও, আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুনিকে গ্রেফতার করো" এই বলে ডিআইজি সনাতনের দিকে দুটো ফাইল এগিয়ে দিল।
ফাইল দুটো নিয়ে সনাতন তাতে একটু চোখ বুলিয়ে নিয়ে উঠে পরল, "ঠিক আছে স্যার, এখন উঠি? আপনাকে সময় মতো রিপোর্ট দিতে থাকব।"
"ঠিক আছে, এসো। সনাতন এন্ড অভি, বেস্ট অফ লাক বোথ অফ ইউ।"
দুজনেই ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিল।

গাড়িতে বসে অভি সনাতনকে জিজ্ঞাসা করল, "স্যার কোথা থেকে শুরু করবেন?"
"তোমার কি মনে হয়, প্রথমেই আমাদের কি করা উচিৎ?" সনাতন রসিকতার মোড়কে অভির দিকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল
"আমার মনে হয় খুনের স্পটটা একবার ঘুরে লোকাল থানার যে অফিসার এই ঘটনার তদন্তে আছেন তাঁর সাথে একবার কথা বলে নেওয়া দরকার।"
"এই তো, তোমার বুদ্ধি খুলছে" সনাতনের চোখে প্রসন্নতার ছাপ দেখা গেল। "অভি, লোকাল থানায় ফোন করে আইও-কে স্পটে পৌঁছাতে বলো।"
কলকাতা থেকে বর্ধমানের দিকে যেতে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়েতে ডানকুনি টোল প্লাজা থেকে সাড়ে চার কিলোমিটার আগে বাম দিকে একটা ঝোপের পাশে পুলিশের ব্যারিকেড, ইতস্ততঃ উৎসাহি মানুষ জিজ্ঞাস্য দৃষ্টি নিতে ঘুরঘুর করছে। সনাতনদের গাড়িটা এসে দাঁড়াতেই এক পুলিশ অফিসার ছুটে এলো। সনাতন গাড়ি থেকে নেমে একটা সিগারেট ধরাল।
"গুড মর্নিং স্যার। আমি এসআই আব্দুল করিম, এই কেসের আইও" সনাতনকে স্যালুট করল ঐ পুলিশ অফিসার।
"মর্নিং। চলুন করিম সাহেব একবার স্পটটা দেখে নিই।"
"সিওর স্যার। চলুন" এসআই করিম সনাতনকে পথ দেখিয়ে ঝোপের ভিতরে যেখানে মৃত দেহটা পরে ছিল সেখানে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে সনাতন আর অভি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখল।
"তা করিম সাহেব কি বুঝছেন? আপনার কি মনে হয়? আর ভিক্টিমের নাম কি?" সনাতন জিজ্ঞাসা করল।
"স্যার, ভিক্টিমের নাম মিস এমালিয়া মার্টিন। এখনো স্যার এমন কোনো ক্লু পাইনি যেটা ধরে এগিয়ে যেতে পারি।"
"রেপ তো হয় নি বলছেন। ফরেন্সিক আর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কি হাতে পেয়েছেন?"
"পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেয়েছি, এই নিন স্যার। গত পাঁচ তারিখ রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ খুনটা হয়েছে" এসআই একটা ফাইল সনাতনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল "ফরেন্সিক রিপোর্টটা আজ কালের মধ্যেই চলে আসবে স্যার।"
"রিপোর্টটা আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন", জ্বলন্ত সিগারেট শেষাংশটা পা দিয়ে মারিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, "ভিক্টিমের পরিচিতদের সাথে আপনি তো কথা বলেছেন, ওনারা কি কাউকে সন্দেহ করছেন?"
"না স্যার। ওনারা প্রত্যেকেই বলেছেন ইনি খুবই শান্ত ও মিশুকে সভাবের মহিলা ছিলেন। ওনার যে কেউ শত্রু হতে পারে তা বিশ্বাস করাই মুসকিল।"
"ঘটনার দিন ভিক্টিমের কিরকম এটিচ্যুড ছিল, সারাদিন কি করেছিলেন সে সব খবর নিয়েছেন?"
"আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার। সারাদিন অফিসেই ছিলেন তবে উনি অন্যদিনের তুলনায় সেদিন বেশি উৎফুল্ল ছিলেন। অফিস থেকেও একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়েছিলেন।"
"হুম গুড, গুড জব" সন্তুষ্টির স্বরে সনাতন বলল তারপর অভিকে বলল, "কি বুঝলে হে অভি?"
"স্যার, সকাল বেলার ঘুম থেকে জোর করে তুলে নিয়ে চলে এলেন, এখন এগারোটা বাজে। সকাল থেকে পেটে একটাও দানা-পানি পরে নি। খালি পেটে আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না স্যার", মাথা চুলকাতে চুলকাতে অভি জবাব দিল।
"এখানে তো কিছু দেখছি না, খাবে কি?" সনাতন চারিদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নিয়ে বলল "ঐ যে একটা মিষ্টির দোকান দেখতে পাচ্ছি, চলো দেখি সিঙাড়া পাওয়া যায় কিনা।"
দোকানটা ছিল ঘটনা স্থলের ঠিক উল্টো দিকে। ওরা দুজন গাড়ি নিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে ক্রসিং থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে এসে দোকানের সামনে পৌঁছাল।
দোকানে পৌঁছে ওরা দু প্লেট সিঙাড়া অর্ডার করে চেয়ারে বসল। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে অভি মুচকি হেসে বলল, "গরুর গাড়ির আবার হেড লাইট!"
"মানে?" অবাক হয়ে সনাতন জিজ্ঞাসা করল।
"স্যার ঐ দেখুন সিসি টিভি ক্যামেরা। ভারি তো দোকান তার আবার সিসি টিভি ক্যামেরা। ভাবটা এমন যেন কলকাতার কেসি দাসের মিষ্টির দোকান।"
"হা হা হা......, ওঃ অভি তুমি পারও বটে" হাসতে হাসতে সনাতন জবাব দিল।

অফিসে ঢুকে সনাতন দু'কাপ চা দিতে বলে ফাইলগুলো খুলে বসল। খুব মনোযোগ দিয়ে রিপোর্টগুলো পরছে আর সেই সাথে মৃতদেহের ছবিগুলো দেখছে। কোনো দিকে মন নেই। অভি বার কয়েক ডাকার পর সারা পেল-
"কিছু কি বললে অভি?"
"স্যার, আমি আপনাকে অনন্ত পাঁচবার ডাকলাম তবে আপনি সারা দিলেন। আছা আপনি কি আজ সকালের ঘটনার প্রতিশোধ নিলেন নাকি? আমি কিন্তু স্যার সত্যিই শুনতে পাই নি" আবদারের সুরে গড়গড় করে অভি কথাগুলো বলে গেল।
মুচকি হেসে সনাতন অভিকে তাকে ডাকার কারন জিজ্ঞাসা করল। অভি জানাল বেয়ারা অনেকক্ষণ আগে চা দিয়ে গেছে, চা টা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
সনাতন চায়ের কাপটা এগিয়ে নিল, তারপর একটা চুমুক দিয়ে বলল, "অভি আমার কাছে খবর আছে বিহার, ওড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড আর মধ্যপ্রদেশে গত কয়েক মাসে এই ধরনের কয়েকটা খুন হয়েছে। তুমি আজই লেগে পড়ো। এই সব ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য আমার চাই। ঘটনাগুলোর তদন্ত প্রক্রিয়ার অগ্রগতি, গ্রেফতার হওয়া বা না হওয়া সাসপেক্টদের সম্পর্কিত তথ্য ইত্যাদি যাবতীয় রিপোর্ট আমার চাই।"
"স্যার এটা কি কোনো সিরিয়াল কিলিং-এর ঘটনা বলে মনে হচ্ছে?" অভির চোখ ফেটে উৎসাহের ঝলক বেরিয়ে আসছে
চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে সনাতন বলল, "এটা যে সিরিয়াল কিলিং তা এখনি বলা যাচ্ছে না। প্রথমত সবকটা খুনই যে একজনই করেছে তা বলা যাচ্ছে না আর তাছাড়া একজনই একাধিক খুন করলেও তাকে সিরিয়াল কিলার বলা যায় না, এর নির্দিষ্ট সং আছে।"
"সিরিয়ার কিলারের আমার সংজ্ঞা আছে?" অভি খুব অবাক হলো
"নিশ্চয়ই আছে। আচ্ছা অভি বলতো সিরিয়াল কিলার কথাটা প্রথম কে ব্যবহার করেন?"
অভি ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিল যে সে জানে না।
"১৯৭৪ সালে পুলিশ স্টাফদের এক সেমিনারে নিজের বক্তৃতায় একটি ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে এই টার্মটা প্রথম ব্যবহার করেন বিখ্যাত এফবিআই স্পেশাল এজেন্ট রবার্ট রেসলার। ২০০৪ সালে লেখক অ্যান রুল তাঁর বিখ্যাত ক্রাইম থ্রিলার উপন্যাস 'কিস মি, কিল মি' তে এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করার পর এটা রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যায়।"
"আর স্যার একজন ব্যক্তিকে কখন সিরিয়াল কিলার বলা যায়?" অভিরূপ এখন রীতিমত উত্তেজিত। তার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে।
সনাতনের চায়ের কাপে অন্তিম চুমুক দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল তারপর একটা লম্বা টান দিয়ে উপর দিকে মুখ করে ধোঁয়া ছেড়ে বলতে আরম্ভ করল, "সিরিয়াল কিলার হল এমন একজন ব্যক্তি যে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে সাধারণত তিন বা ততোধিক লোককে খুন করেছে একটি অস্বাভাবিক মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতির মধ্যে। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সময়কালও অন্তর্ভুক্ত থাকে। বেশিরভাগ কর্তৃপক্ষ তিনটি হত্যার দ্বারা নির্ধারণ করে, অনেকে আবার এটিকে চারটি বা দুজনেও কমিয়ে দেয়।
অর্থাৎ প্রতিটি খুনের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট সময়ের সুত্র থাকবে, লোকটার মানসিক বিকারগ্রস্ত হবে যা সুপ্ত থাকে, তার সেই বিকার অবশ্যই তার কোনো অন্ধকার অতীত থেকে আসে। অনেক সময় যে পদ্ধতিতে খুনগুলো করা হয় তার পিছনেও একটা নির্দিষ্ট কারন থেকে।"
অভি মনোযোগী ছাত্রের মতো এতক্ষণ সব শুনেছিল, সনাতনের কথা শেষ হতেই সে বলল, "স্যার, আপনার কথা মতো ঐ সমস্ত তথ্য আমি দিন কয়েকের মধ্যেই জোগাড় করছি কিন্তু এই মুহূর্তে তদন্ত কোথা থেকে শুরু করবেন?"
"এক কাজ কর, মিস এমালিয়ার সেদিন অফিস থেকে বেরোনোর পর উনি যেদিকে যেদিকে গিয়েছিলেন সেই সব রাস্তার সিসি টিভি ফুটেজ জোগাড় করো, সেগুলো খুঁটিয়ে দেখো কিছু পাওয়া যায় কিনা।"

দুদিন হয়ে গেল তদন্তে সেভাবে কোনো অগ্রগতিই হয় অথচ আছ ডিআইজি সাহেবকে তদন্ত সম্পর্কিত রিপোর্ট দিতে হবে। সনাতন বেশ চিন্তিত। কি বলবে গিয়ে! সনাতন ভেবে কোনো কূল কিনারা পাচ্ছে না। যাই হোক যেতে তো হবে, কিছু একটা তো বলতেই হবে তাই সনাতন বেরিয়ে পড়ল।
অফিসে ঢুকতেই সনাতন দেখল ডিআইজির সাথে কেউ একজন বসে আছে, বয়স প্রায় বছর ষাট হবে তবে শরীরে বয়সের ছাপ নেই, শক্তপোক্ত ফিট ফিগার। পোশাক দেখে বেশ সম্ভ্রান্ত বলে মনে হচ্ছে। ডিআইজির সাথে সনাতনের চোখাচোখি হতেই ডিআইজি সনাতনকে ডাকল, "এসো সন্তু, পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি হলেন বিখ্যাত ব্যবসায়ী মৃণাল দত্ত আর মিঃ দত্ত ইনি আমাদের ডিপার্টমেন্টের রত্ন গোয়েন্দা অফিসার সনাতন মিত্র।"
দুজনে পরস্পরকে প্রনাম করে অভিবাদন জানাল তারপর মৃণাল বলল, "মিঃ মুখার্জি সনাতনবাবুর আমি অনেক নাম শুনেছি। উনি অনেক কমপ্লিকেটেড কেস সলভ করেছেন তা আমি জানি।"
সনাতন বিনয়ী কন্ঠে ধন্যবাদ জানিয়ে চেয়ারে বসল।
ডিআইজি বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে ডেকে সনাতনকে চা দিতে বলল তারপর বলল, "সন্তু তুমি এলে বটে তবে আমাকে একটু বেরোতে হবে। সিএমের সাথে একটা মিটিং আছে আর তারপর আমি মিঃ দত্তর ওখানে যাবো, একটা পার্টি আছে।"
সনাতন মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাল, এখনই তাহলে কিছু বলতে হবে না। হাতে একটু সময় পাওয়া গেল।
ডিআইজির কথা শেষ না হতেই মৃণাল সনাতনকে বলল, "মিঃ মিটার আপনিও চলুন না, আমার বিজনেসের আন্দামানের ইউনিটের সাকসেস পার্টি দিচ্ছি। বেশি দূরে নয়, বাইপাশের ধারেই একটা হোটেলে। সব স্টাফরা থাকবে। আপনি আসবেন কিন্তু অবশ্যই"
"মাফ করবেন মিঃ দত্ত, আমি একটা কেস নিয়ে ভিশন পাজেল্ট হয়ে আছি, সেই কেসের ব্যাপারেই আমাকে একটু বাইরে যেতে হবে", মুচকি হেসে সনাতন আবার বলল, "আর একটা কথা ওটা মিটার নয় মিত্র হবে।"
"ওহ্ সিওর। পরের বার কিন্তু আসতেই হবে। এখন থেকে বলে রাখলাম"
"অবশ্যই যাবো। স্যার আমি তাহলে এখন উঠি?"
ডিআইজির কাছ থেকে সনাতন বিদায় নিল।

অফিসে বসে সনাতন সিগারেটের পর সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে কিন্তু মাথায় কিছুই ঢুকছে না, একটা জায়গায় থেকে শুরু করেছিল কিন্তু তাও নিষ্ফলা হয়েছে। এমালিয়ার যাত্রা পথের সিসি টিভি ফুটেজ থেকে তেমন কিছুই পাওয়া যায় নি, এমন কি মোবাইল নম্বরের কল হিস্ট্রি বা টাওয়ার লোকেশন থেকেও কোনো সাহায্য পাওয়া যায় নি। এখন কোথা থেকে কি সুত্র পাওয়া যায়! এদিকে ব্যক্তিগত ও ডিপার্টমেন্টাল বিভিন্ন সোর্স থেকেও কোনো লিড পাওয়া যাচ্ছে না। ঠিক সেই সময় মাথায় এলো সোসাল মিডিয়ার কথা। হ্যাঁ এখান থেকেই আবার শুরু করতে হবে। ল্যান্ড ফোনের রিসিভারটা টেনে নিয়ে সনাতন কয়েকটা নম্বর টিপে ডায়াল করল, ফোনের ওপার থেকে সাড়া পেতেই "সতীশকে পাঠিয়ে দিন" বলে ফোনটা রেখে দিল। সতীশ, অর্থাৎ ইন্সপেক্টর সতীশ দাস, কালো করে পেশিবহুল শরীর। সাইবার অপরাধ শাখার অত্যন্ত দক্ষ অফিসার। সাইবার দুনিয়ায় সমস্ত খুঁটিনাটি তার নখদর্পণে।
"মে আই কামিন স্যার?" দরজায় টোকা দিয়ে সতীশ ভিতরে আসার অনুমতি চাইল।
"এসো সতীশ। একটা ভিষন ইম্পর্টেন্ট কাজ আছে।" এমালিয়া মার্টিনের যাবতীয় তথ্য সতীশকে দিয়ে সনাতন বলল, "এনার সমস্ত সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটের যাবতীয় এক্টিভিটির তথ্য, চ্যাট হিস্ট্রি সব আমার চাই। ইমিডিয়েট।"
"ওকে স্যার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি সমস্ত ডিটেলস আপনাকে দিচ্ছি" বলে সতীশ বেরিয়ে গেল।

দুপুরের খাবারটাও সনাতন মনে দিয়ে খেতে পারল না। এতো দুর্জ্ঞেয় তাকে আগে কোনো কেসে হতে হয় নি। চেয়ারের বসে যখন সনাতন নিজের মনেই সুত্র হাতরাচ্ছে তখনই অভির আবির্ভাব হলো।
"স্যার, আপনার কথামতো সব তথ্য নিয়ে চলে এসেছি। কিন্তু সমস্যা হলো প্রতিটা ক্ষেত্রেই পুলিশ ক্লুলেস।"
"খুনগুলো কি ভাবে হয়েছে?" সনাতনকে এখন আরও চিন্তিত লাগছে।
"স্যার সেম টু সেম। একইভাবে প্রথমে ব্রেইস্ট দুটো কাটা হয়েছে তারপর মুখটা থেঁতলে থেঁতলে ব্রুটেলি খুন করা হয়েছে।"
"ইজ এনি অফ দেম রেপড?" সনাতন জিজ্ঞাসা করলে অভি মাথা নেড়ে জানাল না তাদংর কেউ ধর্ষিতা নয়।
"প্রত্যেকেই কি বিদেশি?"
"হ্যাঁ স্যার, প্রত্যেকেই বিদেশি এবং কেউ কিন্তু একই দেশের নয়, আলাদা আলাদা দেশের। তারা রাশিয়া, ইংল্যান্ড, ইজিপ্ট ও ভেনেজুয়েলার মহিলা।
"হুম। আমার ধারনা খুনি এক জনই, না হলে এতোটা মিল হয় না।" কিছুক্ষণ চুপ থেকে সনাতন বলল, "জানো অভি লালবাজারের ইতিহাস নিয়ে পড়তে গিয়ে আমি একটা ঘটনা পড়েছিলাম, একেবারে একই রকম ভাবে একটি দশ বছরের শিশু তার মাকে হত্যা করেছিল। ঘটনাটা ১৯৭১ সালের। যদিও শিশুটির বাবা শুরুতে সব দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে নেয় কিন্তু তদন্তে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসে।"
এই ঘটনা শুনে অভি যেন আকাশ থেকে পড়ল, "স্ট্রেঞ্জ! একটা শিশু কিভাবে তার মাকে এইরকম নৃশংসভাবে হত্যা করতে পারে তা আমার মাথাতেই ঢুকছে না স্যার!"
"সে সব বড়লোকের কেচ্ছা। শিশুটির বাবা বড় ব্যবসায়ী, নাম অপরেশ সরকার। শিশুটির নাম ছিল সমরেশ। অপরেশবাবুর স্ত্রী ছিলেন মডেল। শরীরের গঠন নষ্ট হয়ে যাবে এই আশংকায় তিনি তাঁর ছেলেকে স্তন দিতেন না। ইন ফ্যাক্ট তিনি তো বাচ্ছাটিকে জন্ম দিতেই চান নি। শিশুটির উপর নানাভাবে অত্যাচারও করতেন। ধীরে ধীরে শিশুটি মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পরে আর তারই ফল এই হত্যাকাণ্ড।"
"তারপর বাচ্ছাটার কি হলো?"
"শুনেছি বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে জুভেনাইল হোমে পাঠানো হয়েছিল, তারপর আর জানি না।"
"স্যার, আর একটা ইনফরমেশন আছে, ঈশাবেল্লা রডরিগেজের মোবাইলটা পাওয়া যায় নি
রাত আটটা বেজে গেছে। সনাতন অফিসে করিডোরে পায়চারি করছে। কপালে চিন্তার ভাঁজ। এমন সময় সতীশ এলো। ওকে খুব নিরাশ দেখাচ্ছে। সে এসে সনাতনকে জানাল যে এমালিয়ার একমাত্র ফেসবুক ছাড়া আর অন্য কোনো সোশাল সাইটে কোন একাউন্ট নেই এবং ফেসবুকের একাউন্টটাও প্রায় ইনএক্টিভ।
নিরাশ সনাতন অভিকে খুন হওয়া বাকি চার মহিলার তথ্য সতীশকে দিতে বলে তাদের তথ্য বের করার নির্দেশ দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল।

রাত তখন দশটা বাজে। কয়েক পুরুষ আগেকার দম দেওয়া দেওয়াল ঘড়িটা দশটা ঘণ্টা পিটিয়ে তার জানান দিল। আজ সনাতন আর নিজের বাড়ি যায় নি, অভির বাড়িতেই থেকে গেছে যদি দুজনের আলোচনায় কোনো সুত্র বেরিয়ে আসে এই আশায়। অভি আজ তার স্পেশাল মটন রেজালা রান্না করছে। সনাতন গলায় দু'পাত্র রাম ঢেলে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছে তার মুখমণ্ডলের চোখদুটো খোলা থাকলেও মনের চোখ বন্ধ। চিন্তা তার মনের চোখের উপর পর্দা ফেলে দিয়েছে। তার কাছে সবই মরীচিকা মনে হচ্ছে। মরুভূমিতে তৃষ্ণার্ত পথিক যেমন মরীচিকার দিকে ছুটে যায় সনাতনও একই ভাবে ছুটে গিয়েছিল কিন্তু প্রতিটা ক্ষেত্রেই তাকে নিরাশ হতে হয়েছে। ঠিক সেই মুহূর্তে মোবাইলটা বেজে উঠল। উঠে গিয়ে মোবাইলের পর্দায় দেখল সতীশের নাম ভেসে উঠেছে। তবে কি ও কোনো ক্লু পেল? মনে আবার একটা আশা জাগল। ফোন ধরতেই ওপার থেকে সতীশের উৎসাহি আওয়াজ ভেসে এলো। সে সনাতনকে জানাল যে এমালিয়া মার্টিনের 'ওয়ান্না ডেট ইউ ডট কম' নামের একটা ডেটিং ওয়েবসাইটে একাউন্ট আছে এবং তার মাধ্যমে ইদানীং পিটার ডিকোস্টা নামের একজনের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল আর তাদের চ্যাট হিস্ট্রি থেকে জানা যাচ্ছে যে তারা গত পাঁচ তারিখ দেখা করার পরিকল্পনা করেছিল। এই কথা শুনে সে যে ধরে প্রাণ পেল। এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুত্র আর এই সুত্র ধরেই এই কেসের জট খুলবে বলে তার আশা। সন্তু সতীশকে নির্দেশ দিল যাতে সে বাকী ভিক্টিমদেরও ওই ওয়েবসাইটে একাউন্ট আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে আর থাকলে পিটারের সাথে তাদের যোগাযোগ আছে কিনা দেখতে বলল।
খাবার টেবিলে অভি লক্ষ্য করল সনাতনের মধ্যে সেই অন্যমনস্কতাটা আর নেই। খাওয়ার শেষে হাত মুখ ধুয়ে সনাতন একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেট খেতে খেতে সে অভির রান্নার খুব প্রসাংশাও করল। অভি কাছে সনাতনের এই পরিবর্তন একটু আশ্চর্যের ঠেকছিল। মুচকি হেসে অভি বলল, "স্যার, পেটে দু'পাত্র পরতে না পরতেই দেখছি সব টেনশন হাওয়া!"
"হা-হা-হা" সনাতনের অট্টহাসিতে যেন ৬ রিক্টারস্কেলের ভূমিকম্প এলো। তারপর বলল, "অভি, এটা পেটে দু'পাত্র যাওয়ার এফেক্ট নয়, এটা কানে দু'শব্দ যাওয়ার এফেক্ট।" অভি এর অর্থ কিছু বুঝতে পারল না শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তখন সনাতন সতীশের সাথে তার কথোপকথন সংক্ষেপে অভিকে বলল। সতিনের দেওয়া এই তথ্য অভিকেও খুব উৎসাহিত করল।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সনাতন অভিকে খুন হওয়া মহিলাদের নাম পরপর বলতে বললে অভি একটা কাগজ নামগুলো বলতে লাগল
১লা জুলাই বিহারের সমস্তিপুরে খুন হয় একাটেরিনা লিয়াডোভা, এরপর ১৯শে আগস্ট ওড়িষ্যার চাঁদপুরে নেল্লি সালাভি, তারপর ২৪শে সেপ্টেম্বর মধ্যপ্রদেশের রাভাতে ঈশাবেল্লা রডরিগেজ, ১৯শে অক্টোবর ঝাড়খণ্ডের রামগড়ে এলেক্স কেলি আর সব শেষ ৪ঠা নভেম্বর এমালিয়া মার্টিন।"
প্রায় অর্ধেক রাত পর্যন্ত চিন্তা করেও সনাতন এই নামগুলো থেকে কোনো সুত্র খুঁজে বের করতে পারল না। এরই মাঝে কখন যেন নিজের অজান্তেই সে ঘুমের দেশে পারি দিল।

সকাল থেকে অফিসে বসে সনাতন আর অভিরূপ খুন হওয়া মহিলাদের নাম গুলো থেকে সুত্র বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছে যদিও তারা এখনো নিশ্চিত নয় যে এই সব কটা ঘটনার ক্ষেত্রেই চক্রান্তকারী এক জনই। দুপুর গড়িয়ে গেল কিন্তু কোনো সুত্র পাওয়া গেল না। এমন সময় সতীশ এসে হাজির হলো। সতীশকে দেখে সনাতন এমনই অভিব্যক্তি প্রকাশ করল যেন সে তার অপেক্ষাতেই ছিল।
"এসো এসো সতীশ, বোসো" সনাতন তার টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে সতীশকে বসতে বলল।
সতীশ কিছু বলার জন্য যেন খুব উদ্গ্রীব, চেয়ারের বসেই সঙ্গে সঙ্গে বলতে শুরু করল, "স্যার ইন্টারেস্টিং ইনফরমেশন আছে।"
"তাড়াতাড়ি বলো। তোমার ইনফরমেশনের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।"
"স্যার খুন হওয়া প্রত্যেক মহিলারই 'ওয়ান্না ডেট ইউ ডট কম'-এ একাউন্ট ছিল এবং এমালিয়ার সাথে পিটার ডিকোস্টাকে যেমন পাওয়া গেছে তেমনি বাকি মহিলাদের ক্ষেত্রেও কাউকে না কাউকে পাওয়া গেছে। তবে প্রত্যেকের আলাদা পরিচয়।"
"তবে কি একজন নয়? এর পিছনে কি কোনো গ্যাং কাজ করছে?" সতীশের কথার মাঝেই অভি জিজ্ঞাসা করল। সনাতন বিরক্ত হয়ে বলল, "আঃ অভি! সতীশকে শেষ করতে দাও। বলো সতীশ।"
"স্যার ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা হলো ওদের পরিচয় আলাদা হলেও একই আইপি এড্রেস থেকে একাউন্টগুলো অপারেট হয়েছে, আর তা হয়েছে আন্দামান থেকে।"
"ওকে সতীশ, অনেক ধন্যবাদ, এখন তুমি আসতে পারো, প্রয়োজনে তোমাকে আমি ডেকে নেব।" সতীশকে বিদায় দিয়ে অভিরূপকে সনাতন বলল যে তার বিশ্বাস এটা একই জনের কাজ। নাম পাল্টে একজনই এই একাউন্টগুলো অপারেট করছে এবং সেক্ষেত্রে এই পিটার নামের একাউন্টটাও ভুয়ো।

সনাতনের হাতে এই কেস আসার পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে। ছয় তারিখে ডিআইজি এই কেসের ফাইল সনাতনের হাতে তুলে দিয়েছিল আর আজ তেরো তারিখ। হটাৎই সনাতনের চোখ চলে গেল টেবিলের উপর রাখা একটা কাগজের উপর যাতে অভি মৃতদের নামের সাথে তাদের দেশের নাম লেখা আছে।
"অভি দেশের নামগুলো পরপর বলো তো" অভিরূপকে নির্দেশ দিয়ে সনাতন চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিল।
অভি দেশের নামগুলো পরপর বলল-
রাশিয়া
ইজিপ্ট
ভেনেজুয়েলা
ইংল্যান্ড এবং
নিউজিল্যান্ড
চোখ বন্ধ করেই সনাতন নামগুলো মনে মনে কয়েকবার আওড়াল তারপর হটাৎ করে ঝেরেমেরে উঠে বসে অভিরূপকে দেশগুলোর ইংরেজি নামের প্রথম অক্ষরগুলো লিখতে বলল। অভি একটা কাগজে লিখল আর-ই-ভি-ই-এন।
"একজ্যাক্টলি, এর সাথে যদি তুমি 'জি' এবং 'ই' যোগ করো তা হলে হয়ে যায় 'রিভেঞ্জ' অর্থাৎ 'প্রতিশোধ', অভি গিঁট খুলতে শুরু করেছে।"
অভিরূপকে এখন আরও উৎসাহি দেখাচ্ছে, ওর গায়ে কাঁটা দিয়েছে, সে বলল, "স্যার তাহলে নিশ্চয়ই খুনের তারিখগুলোও একটার সাথে আরেকটা জড়িত। সেই সুত্রটা খুঁজে বের করতে পারলে পরের ঘটনাটা হয়তো আটকাতে পারব।"
"একদম ঠিক বলেছ অভি। একটা কাগজে পরপর তারিখগুলো লিখে ফেল তো।"
টেবিলের একপাশে রাখা প্রিন্টার থেকে অভিরূপ একটা কাগজ বের করে তারিখ গুলো লিখে সনাতনের দিকে এগিয়ে দিল। সনাতন তারিখগুলো মন দিয়ে দেখতে লাগল-
১লা জুলাই
১৯শে আগস্ট
২৪শে সেপ্টেম্বর
১৯শে অক্টোবর
৪ঠা নভেম্বর
"কিন্তু স্যার, একটা তারিখগুলোর মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই। এমনও নয় যে এগুলো কোনো বিশেষ দিন" অভি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে বলল।
"তোমার কাছে এই তারিখগুলোর কোনো ইম্পর্টেন্স না থাকলেও খুনির কাছে থাকতেই পারে।" সনাতন উপরের দিকে মুখ করে একটু অন্যমনস্ক ভাবে কথাগুলো বলল।
কিন্তু স্যার তার আছে এই তারিখের কি গুরুত্ব সেটা আমরা জানব কি করে?"
"সেটা না জানলেও কিছু তো একটা সুত্র পাবই। আচ্ছা অভি তুমি কোনো কম্পিটিটিভ এক্সাম দিয়েছে?"
"কি যে বলেন স্যার, না দিলে আমি আইপিএস হলাম কি করে?" লাজুক মুখে অভি জবাব দিল
"ঠিক ঠিক, এই সব কেসের চাপে আমার মাথাটা গেছে একেবারে। এই ধরনের পরীক্ষায় কিছু জেনারেল ইনটেলিজেন্সের প্রশ্ন থাকে না, কিছু সংখ্যা পরপর দেওয়ার পর বলা হয় এই সিরিজের পরবর্তী সংখ্যা কি?"
"হ্যাঁ স্যার, কিন্তু এই ঘটনার সাথে তার সম্পর্ক কি?"
একটু চিন্তা করেই ইউরেকা বলে সনাতন চেঁচিয়ে উঠল, "অভি দেখো ১লা জুলাই আর ১৯শে আগস্টের মধ্যে গ্যাপ ৪৯ দিনের, ১৯শে আগস্ট আর ২৪শে সেপ্টেম্বরের মধ্যে গ্যাপ ৩৬ দিনের,২৪শে সেপ্টেম্বর আর ১৯শে অক্টোবরের মধ্যে গ্যাপ ২৫ দিনের এবং ১৯শে অক্টোবর আর ৪ঠা নভেম্বরের মধ্যে গ্যাপ ১৬ দিনের। কিছু বুঝলে অভি?
"স্যার মানে ৭, ৬, ৫ আর চারের স্কয়ার?"
"একদম তাই" এই বলেই "ও শিঠ" বলে চেঁচিয়ে উঠল। অভিরূপ কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে সনাতন বলল যে এই সুত্র অনুযায়ী পরের গ্যাপ হয় ৯ দিনের আর আজই আর একটা খুন হবে।
"অভি এটা জানা সত্ত্বেও আমাদের হাতে এমন কোন তথ্য নেই যে আমরা এই খুনটা আটকাতে পারি।"
কথা শেষ হতে না হতেই সনাতন টেবিলের উপর হাত দিয়ে মেরে আফসোসের সুরে আবার "শিট" বলে দুবার চেঁচিয়ে উঠল আর তারপরই চেয়ার ছেড়ে উঠে অভিকে বলল, "ওঠো, এখুনি বেরোতে হবে।"
অভিও বলা মাত্রই উঠে পড়ল। দু'জনে প্রায় ঝড়ের বেগে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। গাড়িতে ওঠার আগে অভি সনাতনের কাছে জানতে চাইল যে তারা কোথায় যাচ্ছে। জবাবে সনাতন বলল, "তোমার কে সি দাসের মিষ্টির দোকানে"
"মানে?" অভিরূপ অবাক হলো
"আরে বাবা সেদিন ঐ মিষ্টির দোকানে সিসি টিভি ক্যামেরা লাগানো আছে দেখলে না? আমি নিশ্চিত ওখানে থেকে কিছু না কিছু পাওয়া যাবেই।"

মিষ্টির দোকানে পৌঁছে অভি নিজেদের পরিচয় দিতে ক্যাশে বসে থাকা মালিক আর দুজন কর্মচারী শশব্যস্ত হয়ে পড়ল। এক কর্মচারীকে দুটো চা দিতে বলে মালিক কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এসে বিনয়ী হয়ে অভিরূপকে জিজ্ঞাসা করল-
"স্যার, আপনাদের কি হেল্প করতে পারি?"
"আপনার দোকানের বাইরে যে সিসি টিভি ক্যামেরাটা আছে আমরা তার ফুটেজ দেখতে চাই" অভি জবাব দিতেই "নিশ্চয়ই স্যার" বলে দোকানের মালিক ক্যাশ কাউন্টারের কম্পিউটারটা তাদের দিকে ঘুরিয়ে দিল। তারা দুজনে নির্দিষ্ট সময়ের ফুটেজ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখল। গাড়িটার একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। সাদা রঙের বড় কোনো বিদেশি গাড়ি যেটা কলকাতার দিক থেকে এসে দাঁড়ালো, কিছুক্ষণ পর চলে গেল। চলে যাবার সময় পিছনের নম্বর প্লেটের ডান দিকের অংশটা আবছা দেখা যায় যাতে উপরে ইংরেজি 'এক্স' অক্ষর আর নিচে ৭৬ দেখা গেল।
সনাতন বলল, "কলকাতা থেকে এখানে আসতে হলে হয় বালি ব্রিজ পেরিয়ে আসতে হবে অথবা সেকেন্ড হুগলি ব্রিজ পেরিয়ে সাঁতরাগাছি হয়ে আসতে হবে। কিন্তু গাড়িতে লাশ নিয়ে কেউ নিশ্চয়ই টোল প্লাজা পেরিয়ে আসতে চাইবে না। সেক্ষেত্রে এও নিশ্চয়ই বিদ্যাসাগর সেতু বা নিবেদিতা সেতু পেরিয়ে আসে নি। এসেছে বিবেকানন্দ সেতু অর্থাৎ পুরনো বালি ব্রিজ পেরিয়ে।" এর পরেই অভির দিকে তাকিয়ে বলল, "অভি তুমি ওয়ারলেসে এখুনি ইনফরম করে দাও বিবেকানন্দ সেতুর আশেপাশের সিসি টিভি ক্যামেরার ফুটেজ চেক করতে আর এই গাড়ির তথ্যগুলো দিয়ে দাও। গাড়িটা বিবেকানন্দ সেতু দিয়েই এসেছিল, আই এম কোয়াইট সিওর এবাউট দ্যাট।"
অফিসে ফেরার পথেই যাবতীয় তথ্য হাতে চলে এলো। সাদা রঙের ফর্চুনার গাড়ি, নম্বর ডব্লিউবি ০২ এক্স ৯৮৭৬, গাড়ির মালিকের নাম মৃণাল দত্ত। নামটা শুনেই সনাতন চমকে উঠে জানতে চাইল ওটা ব্যবসায়ী মৃণাল দত্ত কিনা। অভি জানিয়ে বলল "তবে স্যার উনি ঘটনার দুদিন আগে এই গাড়িটার চুরি যাওয়ার রিপোর্ট লিখিয়েছিলেন"
"অভি তবে চলো অফিসে না গিয়ে সোজা মৃণালবাবুর সাথেই দেখা করা যাক।"

মৃণাল দত্তর অফিসে গিয়ে রিসেপশনে সনাতন আর অভিরূপ নিজেদের পরিচয় দিয়ে জানাল যে তারা মৃণাল দত্তর সাথে দেখা করতে এসেছে। রিসেপশনে বসা বছর চব্বিশের মেয়েটা ইন্টারকামে কারোর সাথে কথা বলল তারপর দুজনকে দুটো গলায় ঝোলানো ভিজিটরস্ কার্ড দিয়ে পাঁচ তলায় যেতে বলল।
অফিসের টপ ফ্লোরে মৃণাল দত্তর কেবিনের পরিবেশটা খুব মনোরম। বড় কেবিনের একদিকে সোফা আর টি টেবিল পাতা। অন্য দিকে বিরাট টেবিল যার এক প্রান্তে মৃণালের চেয়ার আর অপর প্রান্তে পরপর চারটে চেয়ার পাতা। কেবিনের উত্তর দিকে দেওয়াল সমান কাঁচের জানালা দিয়ে সবুজ ময়দান দেখা যাচ্ছে আর একদিকে প্রবহমান শান্ত গঙ্গার মনোরম দৃশ্য।
সনাতন আর অভিরূপ কেবিনে ঢুকতেই মৃণাল চেয়ারের ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল, "আরে আমার কি সৌভাগ্য! এতো মেঘ না চাইতেই জল! আসুন আসুন।"
সনাতন দেখল ভিতরে মৃণালের সমবয়সী আর একজন বসে আছে।
"আসুন পরিচয় করিয়ে দিই" সামনে বসা ব্যক্তির দিকে ইশারা করে বললেন ইনি আমার বিজনেস পার্টনার ধ্রুবজ্যোতি ধারা। বেশিক্যালি আমেরিকার নাগরিক তবে বেশিরভাগ সময় ভারতেই থাকেন। আমার মামার সময় থেকেই আমাদের সাথে আছেন। একেবারেই আমার ভাইয়ের মতো। আর ধ্রুব, ইনি হলেন বিখ্যাত গোয়েন্দা সনাতন মিত্র আর উনি অভিরূপ চট্টপাধ্যায়।
ধ্রুব উঠে দাঁড়িয়ে সনাতনের সঙ্গে হাত মেলাল তারপর বলল, "আপনার সাথে আলাপ হয়ে ভালো লাগল তবে আমাকে একটা বিশেষ কাজে এখুনি বেরোতে হবে। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।"
ধ্রুবজ্যোতি বেরিয়ে যেতেই সনাতন আর অভিরূপ চেয়ারে বসল। মৃণাল ইন্টারকামে কফি অর্ডার করে বলল, "বলুন ইনসপেক্টর"
"মিঃ দত্ত, আপনার কি কোনো গাড়ি চুরি হয়েছে?"
"হ্যাঁ। সাদা রঙের ফর্চুনার। গাড়ির নম্বর ডব্লিউবি ০২ এক্স ৯৮৭৬।" মৃণাল জবাব দিয়েই একটু আশ্চর্যের সাথে আবার বললেন, "কি ব্যাপার, বলুন তো? আপনার মতো বড়মাপের গোয়েন্দা অফিসার নিশ্চয়ই একটা গাড়ি চুরির তদন্ত করবে না।"
"ঠিকই ধরেছেন। আমি একটা খুনের তদন্ত করছি আর আপনার ঐ গাড়িতে গত পাঁচ তারিখ রাতে একটা লাশ পাচার হয়েছে।"
এরই মধ্যে বেয়ারা কফি নিয়ে ঢুকল। দু কাপ কফি দুজনকে পরিবেশন করে বেয়ারা অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
বেয়ারা বেরিয়ে যেতেই সনাতন ঘটনাটা মোটামুটি বলল। মৃণাল গম্ভীর হয়ে শুনছিল, সনাতনের কথা শেষ হতেই মৃণাল বলল, "অফিসার, আপনি কি আমাকে কোনো ভাবে সন্দেহ করছেন?"
সনাতন মুচকি হেসে বলল, "দেখুন মিঃ দত্ত একজন গোয়েন্দাগিরি মূলধনই হলো সন্দেহ। তাই সন্দেহ করতে ভুলে গেলে তো গোয়েন্দাগিরিও ভুলে যাব। যাই হোক আপনার কাছে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য থাকলে আমাকে জানাবেন। আজ চলি, আবার দেখা হবে" এই বলে সনাতন আর অভিরূপ চলে গেল।

অফিসে যখন সনাতনরা পৌঁছাল তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে এসেছে। সনাতন কে খুব ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত লাগছিল। না পরিশ্রমের ক্লান্তি নয়, এটা পরাজয়ের ক্লান্তি। সারাদিন হন্যে হয়ে ঘুরেও এমন কোন সুত্র সে জোগাড় করতে পারে নি যা দিয়ে আজকের খুনটা আটকাতে পারবে। কেবিনে ঢুকে চেয়ারের উপর ধপ করে বসে পরল। টেবিলের উপর হাতের কনুই দিয়ে ভর দিয়ে হাতের উপর মাথাটা নিচু করে রাখল তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, "অভি আমি পারলাম না, আজকের খুনটা কিছুতেই আটকাতে পারলাম না।"
এরই মধ্যে সেখানে সতীশ এসে জানাল ঈশাবেল্লা রডরিগেজের মোবাইল ফোনটা ট্রাক করা গেছে, তারপর একটা কাগজে লেখা ঠিকানাটা দিয়ে চলে গেল। সনাতন কাগজে লেখা ঠিকানাটা দেখে অভিকে বলল, "অভি এখানে যে এলাকার কথা বলা হয়েছে সেখানেই তো মিঃ দত্তর বাড়ি। কেন জানি আমার বারবার মনে হচ্ছে এই কেসে মিঃ দত্ত জারিত। আবার দেখো এই ভুয়ো একাউন্টগুলো অপারেটর হচ্ছে আন্দামান থেকে আর মিঃ দত্তর বিজনেসের একটা বড় ইউনিট আন্দামানে আছে। প্রতিটা সুত্রই ওনার দিকে ইঙ্গিত করছে" এই বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে পরল।
"চলো আজ ওঠা যাক, কাল আবার একটা মৃত্যু খবর শোনার জন্য তৈরী থাকো।"

পরের দিন সকালে অফিসে পৌঁছাতেই অভি সনাতনকে জানাল যে মৃণাল দত্তর ব্যাপারে ঠিকুজি কুষ্ঠী জোগার হয়ে গেছে। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো মৃণাল দত্ত হচ্ছে ব্যবসায়ী অপরেশ সরকারের ভাগ্নে যার স্ত্রী ১৯৭১ সালে তারই দশ বছরের ছেলের হাতে এই একই পদ্ধতিতে নৃশংসভাবে খুন হয়। এই খবর শুনে সনাতন চমকে উঠল। তারপর একটু চিন্তা করে বলল, "অভি এমনও তো হতে পারে যে মৃণাল দত্তই সমরেশ সরকার, অর্থাৎ যাকে আমরা ভাগ্নে ভাবছি সে আদতে ছেলে?"
"কি বলছেন স্যার!" অভি রীতিমতো স্তম্ভিত
"অভি তুমি এক কাজ করো মৃণালবাবু পিছনে সাদা পোশাকের পুলিশ লাগাতার, ওনার প্রতিটা মুভমেন্টের খবর আমার চাই। আমাকে একটু বেরোচ্ছি হেডকোয়ার্টারের মহাফেজখানা ঐ কেসের ফাইল বের করে একটু স্টাডি করব।"
দুপুরে অভি সনাতনকে ফোন করে জানাল যে রিভেঞ্জের 'জি' পাওয়া গেছে। শিলিগুড়ির কাছে মাটিগাড়া অঞ্চলে এক পরিত্যক্ত চা বাগান থেকে ঘানার নাগরিক এক মহিলার মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে, নাম জ্যানেট আইয়েম। তাকেও একইভাবে স্তন কেটে মুখ থেঁতলে খুন করা হয়েছে।

আজকে সতেরো তারিখ। হিসেব মতো শেষ খুনটা আজকে হওয়ার কথা। কারন ৪৯, ৩৬, ২৫, ১৬, ৯ এই পংক্তিতে এর পরের সংখ্যা ৪ হয়, অর্থাৎ ২এর স্কয়ার। তা সত্ত্বেও সনাতনের মেজাজ আজ ফুরফুরে। অভি লক্ষ্য করল আজ সনাতন হাবভাব এমন যেন কেস সলভ হয়ে গেছে, খুনিও ধরা পরেছে। সনাতনকে এতোটা নিশ্চিন্তে বসে থাকতে গত কয়েকদিন অভি দেখে নি।
"স্যার, আজ সতেরো তারিখ"
"হুম, তো?" সনাতনের গোঁফের কোলে মুচকি হাসির ঝলক
"স্যার, হিসেব মতো আজ আর একটা খুন হওয়ার কথা!"
"হবে না। তার আগেই খুনি ধরা পরে যাবে। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।"
ঠিক সেই সময় সনাতনের ফোনে একটা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ এলো। মেসেজটা দেখেই সনাতন মুচকি হেসে টেবিলে রাখা ল্যান্ড ফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়ে তাতে কয়েকটা নম্বর টিপে ডায়াল করল।
"হ্যালো, স্যার, আমি সনাতন বলছি"
"কেস প্রায় সলভ হওয়ার পথে, আজই খুনি ধরা পরবেই।"
"আমার একটা ফেবার লাগবে"
"মিঃ মৃণাল দত্তর বাড়ির সার্চ ওয়ারেন্ট চাই"
"স্যার আমার উপর বিশ্বাস রাখুন, আপনার চাকরি নিয়ে কোনোরকম টানাটানি হবে না। প্লিজ স্যার।"
"থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ সোমাচ স্যার।"
ফোনের ওপারে কথা শোনা না গেলেও সনাতনের কথা শুনে অভি বুঝতে পারল যে সে ডিআইজিকে ফোন করেছে।
ফোন রেখেই সনাতন বলল, "অভি ইমিডিয়েট দশ-বারো জনের একটা টিম রেডি করো। রেইড করতে হবে। আর হ্যাঁ, সতীশকেও সঙ্গে নিয়ে নিও।"

সনাতন তার দল নিয়ে যখন মৃণাল দত্তর বাড়ি পৌঁছল তখন মৃণাল অফিসের জন্য তৈরী হচ্ছে। সনাতনকে ফোর্স সহ ঢুকতে দেখে মৃণাল অবাক হয়ে গেল, রাগে ভিতরে ভিতরে ফুঁসলেও বাইরে তা প্রকাশ না করে সনাতন কে তির্যক ভাবে জিজ্ঞাসা করল, "কি ব্যাপার অফিসার? ফোর্স নিয়ে কি আমাকে গ্রেফতার করতে এসেছেন নাকি?"
"না। আপাতত আপনার বাড়ি সার্চ করতে এসেছি। সন্দেহজনক কিছু পেলে তখন না হয় গ্রেফতার করব", অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে সনাতন জবাব দিল।
"সার্চ ওয়ারেন্ট আছে?"
"আপনার মতো একজন এতো বড় ব্যবসায়ী যার বড় বড় নেতা মন্ত্রীদের সাথে ওঠা বসা তার বাড়ি কি বিনা ওয়ারেন্টে সার্চ করতে যেতে পারি?" এই বলে সনাতন ওয়ারেন্টের কপিটা মৃণালের দিকে এগিয়ে দিল।
কাগজটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে মৃণাল তল্লাশি শুরু করার জন্য ইঙ্গিত করে সোফায় বলে পরল।
প্রায় ঘন্টাখানেক তল্লাশি চালানোর পর অভি হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল ছাদের চিলেকোঠার ঘর থেকে একটা মোবাইল উদ্ধার হয়েছে যা ঈশাবেল্লার খোয়া যাওয়া মোবাইলটার বর্ণনার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে।
মোবাইলটা নিয়ে সনাতন একবার এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখে সতীশের দিকে এগিয়ে দিয়ে তাকে নির্দেশ দিল যে এটা ঈশাবেল্লার মোবাইল কিনা তা নিশ্চিত করতে। সতীশ তার সাথে থাকা একটা পোর্টেবল মেশিন দিয়ে পরীক্ষা করে জানাল যে আইএমইআই নম্বর মিলে যাচ্ছে, অর্থাৎ এটা ঈশাবেল্লারই মোবাইল।
এটা শুনেই সনাতন মৃণালের দিকে তাকিয়ে বলল "আপনাকে গ্রেফতার করার মতো যথেষ্ট এভিডেন্স পেয়েগেছি মিঃ দত্ত। ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।"

মৃণালের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সনাতন মৃণালকে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে প্রয়োজনীয় আইনি আনুষ্ঠানিকতাগুলো সেরে ফেলার জন্য সতীশকে নির্দেশ দিয়ে অভি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। গাড়ি সনাতন নিজে চালাচ্ছিল। গাড়িতে যেতে যেতে অভি নিশ্চিন্ত সনাতনকে বলল-
"অবশেষে খুনি ধরা পড়ল। স্যার এখন বেশ হালকা লাগছে।"
সনাতন চুপ করে থাকল, কোনো উত্তর দিল না।
"মৃণালবাবুর মতো একজন সাদাসিধে নিরীহ দেখতে মানুষের মধ্যে যে এইরকম একজন কুখ্যাত খুনি লুকিয়ে ছি তা আমি চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না", কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর অভি আবার বলল। সনাতন এখনো চুপ। তাকে এইরকম চুপচাপ থাকতে দেখে অভি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, স্যার এতো বড় একটা কেস সলভ করলেন, এর পরেও এরকম নিরুত্তাপ কেন আপনি?"
"তোমরা কি মনে হয়, কেস সলভড?"
"খুনিই ধরা পরে গেছে যখন তখন নিশ্চয়ই কেস সলভ।"
"মৃণালবাবুকে খুনি প্রমান করার মতো যথেষ্ট প্রমান তোমার হাতে আছে?"
সনাতনের এই প্রশ্নের কোনো উত্তর অভিরূপের কাছে নেই তাই সে ফ্যালফ্যাল করে সনাতনের দিকে তাকিয়ে রইল।
"গল্প এখনো বাকি আছে। গল্পে আসল মোচড় খুব তাড়াতাড়ি দেখতে পাবে।"

বিকেল প্রায় সারে পাঁচটা বাজে। নভেম্বর মাস তাই এরই মধ্যে সূর্য অস্ত গেছে, অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। শহরতলির এই জায়গাটা একটু নির্জন। দেখে কেউ এটাকে কলকাতা বলে বিশ্বাস করবে না। একসময় এখানে ঘন জঙ্গল ছিল, এই এলাকাটা সমাজবিরোধীদের স্বর্গরাজ্য ছিল। এখন চারিদিকে ছোটবড় আবাসন, বাংলো ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। সেইসঙ্গে তৈরী হয়েছে শপিং কমপ্লেক্স, মল, স্কুল, হাসপাতাল, মাল্টিপ্লেক্স ইত্যাদি। তবুও একটু ভিতরের দিকে গেলে সেই নির্জনতাটা থেকেই গেছে।
একটা ফাঁকা বাস স্ট্যান্ডের সামনে এসে সনাতন গাড়িটাকে দাঁড় করালো। অভি বুঝতে পারল এখানে তারা দুজন ছাড়াও সাদা পোশাকের পুলিশ অনেকে আছে। গাড়ি থেকে নেমে সনাতন বলল যে এরপর তারা হেঁটে যাবে। কয়েক পা হাঁটতেই সনাতন অভিকে দেখাল যে একটা বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা নামছে, সনাতন বলল, "অভি এই হচ্ছে 'রিভেঞ্জ'-এর শেষ 'ই'। ঐ মহিলা ইথিওপিয়ান, নাম তেরুয়াঞ্চি গেব্রু। এখুনি, এখানেই এর খুন হওয়ার কথা"
অভি চমকে উঠে চাপা গলায় বলল, "কি বলছেন স্যার? তার মানে মৃণালবাবু খুনি নন? খুনি এখনো ধরা পরে নি?"
"যার বিরুদ্ধে তোমার কাছে কোনো প্রমানই তাকে কি করে তুমি খুনি বলতে পারো?" এই বলে সনাতন অভিকে ইশারায় চুপ করতে বলল।
সামনের বাড়িটাকে সাদা পোশাকের কয়েছেন পুলিশ ঘিরে রেখেছে। গেব্রু লোহার গেটটা খুলে ভিতরে ঢুকল সনাতন আর অভিরূপ পিছনের গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকল। চারিদিক অন্ধকার যেন কালো চাদর দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। তারা দুজন আড়ালে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে। সনাতন কোর্টের ভিতরের পকেট থেকে রিভলবার টা বের করে হাতে ধরল।
গেব্রু অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডাকতে লাগল, "হ্যালো! ইজ দেয়ার এনিওয়ান? হ্যালো মিঃ এলেক্স, দিস ইজ গেব্রু। আর ইউ দেয়ার?" সে উত্তরের আসায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
এমন সময় সনাতন লক্ষ্য করল একটা ছায়া মূর্তি অন্ধকারের চাদর ভেদ করে হাতে একটা রড বা লাঠি জাতীয় কিছু নিয়ে ধীরে ধীরে গেব্রুর দিকে এগিয়ে আসছে। সনাতন অভিকে ইশারায় সেই ছায়া মূর্তিটা দেখাল। অভি ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড উত্তেজিত। সনাতন রিভলবারটা শক্ত করে ধরল। হটাৎ সেই ছায়া মূর্তি হাতের রডটা দিয়ে পিছন থেকে গেব্রুর মাথায় আঘাত করতে যাবে এমন সময় সনাতন তার রিভলবার তাক করে সেই ছায়া মূর্তির হাতে গুলি করল, সঙ্গে সঙ্গে সে ছুটে পালাতে উদ্যত হলে কিছু সাদা পোশাকের পুলিশ তাকে ধরে ফেলল। এদিকে গুলির শব্দে গেব্রু ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল। সনাতন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, "ডোন্ট ওরি মিস গেব্রু, ইউ আর সেফ নাও।"

তারা পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যখন ফিরে এলো তখন প্রায় রাত ন'টা বাজে। ডিআইজির কেবিনে ঢুকতেই অভি মৃণালকে সেখানে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো। সনাতনের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই সনাতন তাকে সবুর করতে বলে চেয়ারে বসল।
মৃণাল সনাতনকে অভিনন্দন জানিয়ে জিজ্ঞাসা করল যে এতো কমপ্লিকেটেড কেস সনাতন কিভাবে সলভ করল। ডিআইজিও তার তদন্ত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে সনাতন এক গ্লাস জল খেয়ে বলতে শুরু করল-
"স্যার ঐ ডেটিং ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্যের সাহায্য আমারর আন্দামান থেকে আমরা একজনকে গ্রেফতার করি যে খুনির হয়ে ঐ ওয়েবসাইট অপারেট করত, বদলে একটা মাসোহারা পেত। তাকে জেরা করে আমারা জানতে পারি যে সে খুনিকে কখনো দেখেইনি। তাই আমরা ঠিক করি যে খুনিকে হাতে নাতে ধরতে হলে ওকে ওর কাজ করতে দিতে হবে। তার মাধ্যমেই ক্রমে জানতে পারি খুনির শেষ টার্গেট ইথিওপিয়ার নাগরিক এক মহিলা যাঁর নাম তেরুয়াঞ্চি গেব্রু। আমি নিজে ওনার সাথে দেখা করে ওনাকে কনফিডেন্সে নিই। তার পর তাঁর পিছনে সিকিউরিটির জন্য তিনজন সাদা পোশাকের পুলিশ লাগিয়ে দিই। এদিকে সাসপেক্টের উপরেও নজর রাখা চলতে থাকে।"
"কিন্তু যদি খুনিকে আগেই আইডেন্টিফাই করে থাকেন তবে আজ সকালে আমাকে কেন গ্রেফতার করলেন? খুনিকে আপনি আইডেন্টিফাই করলেনই বা কিভাবে আর আজ সকালে আমার বাড়ি থেকে যে মোবাইলটা উদ্ধার হলো সেটা?" মৃণাল উদ্গ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
মুচকি হেসে সনাতন বলল, "মিঃ দত্ত আপনাকে অ্যারেস্ট করাটা ছিল একটা নাটক। আপনার বাড়ি থেকে মোবাইলটা উদ্ধার হওয়ার পরেও যদি আপনাকে গ্রেফতার না করতাম তাহলে খুনি বুঝে সতর্ক হয়ে যেত, সেক্ষেত্রে আমাদের প্ল্যানটা ফেল হয়ে যেতে পারত। আপনার গ্রেফতারের খবরে খুনি নিশ্চিন্ত হয়ে যায় ফলে আমার বাকি প্লানটা এক্সিকিউট করতে সুবিধা হয়।"
"অফিসার, খুনিটা কে সেটা আগে বলুন" মৃণাল আর ধৈর্য রাখতে পারছে না।
সনাতন অভিরূপকে ইশারা করতেই অভিরূপ খুনিকে নিয়ে হাজির হল। তাকে দেখে মৃণাল স্তম্ভিত, "হোয়াট! ধ্রুব! ধ্রুব সিরিয়াল কিলার? হোয়াট রাভিস অফিসার?"
"মিঃ দত্ত, আসল টুইস্টটা হলো আপনি যাকে ধ্রুবজ্যোতি ধারা বলে জানেন তিনি আসলে আপনার মামাতো ভাই সমরেশ সরকার"
"কি বলছেন মিঃ মিত্র? আর ইউ সিরিয়াস?"
"সেদিন আপনার অফিস থেকে ফিরে আমি খবর পেলাম যে ঈশাবেল্লা রডরিগেজের খোয়া যাওয়া মোবাইলটা কয়েক মিনিটের জন্য অন হয়েছিল আর তার যে টাওয়ার লোকেশন পাই তা আপনার বাড়ির আসেপাসে। আমার সন্দেহ হয় যে আপনিই হয়তো সমরেশবাবু, আর এই খুনগুলো আপনিই করছেন। কারন সমস্ত এভিডেন্স আপনার বিরুদ্ধে যাচ্ছিল। তাই আমি পুরনো ফাইল বের করে আপনার মামিমার মার্ডার কেসটা স্টাডি করা শুরু করি। সেখানে দেখি সমরেশবাবুর আইডেন্টিফিকেশন মার্ক হিসেবে উল্লেখ আছে ডান হাতে একটা অতিরিক্ত কড়ি আঙুল আর ঘারের পিছনে একটা পোড়া দাগ। আমার মনে পড়ে যায় যে আপনার অফিসে যখন ধ্রুববাবুর সাথে হাত মিলিয়েছিলাম তখন ওনার অতিরিক্ত আঙুল লক্ষ্য করেছিলাম, আর উনি যখন আপনার কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন তখন ওনার পোড়া দাগটা দেখি। তখনই আমি প্রায় নিশ্চিত হয়ে যাই যে উনিই সেই সিরিয়াল কিলার আর সেই মোবাইলটা আপনার বাড়িতেই আছে। কিন্তু আরও নিশ্চিত হওয়ার দরকার ছিল তাই আমি আপনার অফিস থেকে এক বেয়ারাকে দিয়ে ধ্রুববাবুর জলের গ্লাস সংগ্রহ করে সমরেশবাবুর ফিঙ্গার প্রিন্টের সাথে ম্যাচ করছে কিনা তা পরীক্ষা করতে দিই। আজ সকালে সেই রিপোর্ট হোয়াসঅ্যাপে পেয়েই আমি স্যারকে রিকোয়েস্ট করে আপনার বাড়ির সার্চ ওয়ারেন্ট বের করি। বাকিটাতো আপনি জানেনই।"
"সত্যিই মিঃ মিত্র আপনি জিনিয়াস। আপনার ব্যাপারে যা শুনেছিলাম আপনি তার থেকেও অনেক বেশি গ্রেট। কিন্তু আরও একটা কথা জানার বাকি আছে। সমরেশ আমেরিকা কিভাবে গেল আর সেখানকার নাগরিকত্বই বা কি করে পেল?"
কি সমরেশবাবু? বলে ফেলুন," সনাতন কটাক্ষের সুরে সমরেশকে বলল
এতক্ষণ সে চুপ করে ছিল, এবার মুখ খুলল, "আমি জুভেনাইল হোম থেকে পালানোর পর বাবা এক এজেন্টকে দিয়ে আমাকে আমেরিকা পাঠান। সেই এজেন্ট প্রথমে বিহার হয়ে নেপাল নিয়ে যান। সেখানে সপ্তাহ খানেক লুকিয়ে রাখার পর আমাকে সেখানকার যাবতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। সেই পরিচয় পত্রের নিয়ে আমি আমাকে মেক্সিকো হয়ে আমেরিকা নিয়ে যায় সেই দালাল। আমেরিকায় যাওয়ার পর আমি আবার এক নতুন পরিচয় পাই, সমরেশ সরকার।"
"তার মানে মামা সব জানতেন?" মৃণাল অবাক হলো
সনাতন সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, "নিশ্চয়ই। সেই জন্যই তো ওনাকে বিজনেস পার্টনার বানিয়ে দিয়েছিলেন?"
সেই সময় সনাতনের ইশারায় দুজন এসে সমরেশকে নিয়ে গেল।
"কিন্তু স্যার এই ৪৯, ৩৬ ইত্যাদির কি রহস্য তা তো জানা হলো না", এতক্ষণ চুপ থাকার পর অভি জিজ্ঞাসা করল।
"ওটা আমিই বলে দিচ্ছি। মাতৃ স্নেহ, মাতৃ দুগ্ধ থেকে বঞ্চিত সমরেশ এমনিতেই মানসিক স্থিরতা হারিয়েছিল, এমনই সময় একদিন ওনার ওনাকে মা পড়াতে বসেছিলেন, ৪৯এর স্কয়াররুট বলতে না পারায় ঘারে গরম হারিকেন চেপে ধরে। আর সেই দিনই সমরেশবাবু তার মা কে খুন করেন। এর থেকেই এই সিরিজটা এসেছে।"
"অদ্ভুত, ইউ আর অশম" বলে ডিআইজি সনাতনকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিল।
অভি বলল, "স্যার আমার এক বন্ধু, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। যদি আপনি অনুমতি দেন তবে সে আপনার এই তদন্তের ঘটনাগুলো নিয়ে সিরিজ লিখতে চায়। 'ডিটেকটিভ সন্তুর ডায়রি'।"
সনাতন হেসে বলল, "যাক, ফেলু মিত্তির আর তোপসে তো ছিলই এবার জটায়ুও পেয়ে গেলেম।"

**বিধিসম্মত সতর্কীকরণ - এই গল্পের ঘটনা, স্থান, কাল, পাত্র সবই কাল্পনিক। এর সাথে যদি বাস্তবের কারোর কোনো মিল পাওয়া যায় তা নিতান্তই কাকতালীয় বলে গণ্য হবে। ধূমপান ও মদ্যপান স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর, ইহা ক্যান্সারের কারণ।

সৈনিক

সৈনিক           উপেন্দ্র নাথ ব্রহ্মচারী   ছেলেটা গত কালই বাড়ি ফিরেছিল, ছ'মাস পর, মাঝে ছুটি পায়নি সে। ফুলসজ্জার পরের দিন চলে যেতে হয়েছ...